Tuesday , 30 April 2024
শিরোনাম

কৃষিকাজে ইসলামের বিশেষ গুরুত্বারোপ

পৃথিবীর উন্নত, অনুন্নত, উন্নয়নশীল-নির্বিশেষে সব দেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সব উপাদান, শিল্পের কাঁচামাল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যও বেশির ভাগ কৃষি থেকে আসে। ইসলামে কৃষিকাজের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। নিয়ত ও পদ্ধতি সঠিক হলে কৃষি কাজও নেকি অর্জনের মাধ্যম হতে পারে।

ইসলামে কৃষিকাজের প্রতি গুরুত্বারোপ : খাদ্যের মূল উৎস হলো ভূমি। সে ভূমি থেকে খাদ্য-শষ্য ও ফল-ফসল উৎপাদন করার প্রক্রিয়া হলো কৃষিকাজ। অর্থশাস্ত্রের ভাষায়, কৃষি বলতে কেবল ফসল উৎপাদন করাকেই বোঝায় না; বরং উৎপাদন লাভের উদ্দেশ্যে পশুপাখি পালনের মতো কাজও কৃষির অন্তর্ভুক্ত। তাই উৎপাদন লাভের উদ্দেশ্যে কোনো নির্দিষ্ট ভূমিক্ষেত্রে ও তদুপরিস্থ ঘর বা দালান ব্যবহার করে ফসলাদি উৎপাদন ও পশুপালনের প্রয়াস ও কৌশলকে কৃষি বলে। পবিত্র কোরআনে বিভিন্নভাবে কৃষিকাজের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনিই (আল্লাহ) আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন, অতঃপর তা দিয়ে আমি সব ধরনের উদ্ভিদেও চারা উদগম করি; অনন্তর তা থেকে সবুজ পাতা উদগত করি, পরে তা থেকে ঘন সন্নিবিষ্ট শস্যদানা উৎপাদন করি এবং খেজুর বৃক্ষের মাথি থেকে ঝুলন্ত নির্গত করি আর আঙুরের উদ্যান সৃষ্টি করি এবং জায়তুন ও আনারও। এরা একে অন্যের সদৃশ এবং বিসদৃশও। লক্ষ্য করো—তার ফলের প্রতি, যখন তা ফলবান হয় এবং তার পরিপক্বতা প্রাপ্তির প্রতি। মুমিন সম্প্রদায়ের জন্য এগুলোর মধ্যে অবশ্যই নিদর্শন আছে।’ (সুরা আনআম, আয়াত : ৯৯)

নবী-রাসুলদের কৃষিকাজ : পৃথিবীর সূচনা থেকেই কৃষিকাজ বা চাষাবাদের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বিদ্যমান। প্রথম মানব ও প্রথম নবী আদম (আ.) কৃষিকাজ করেছেন। ইবরাহিম (আ.) কৃষিকাজ করেছেন। নবী মুহাম্মদ (সা.)- এর চাষাবাদ করারও প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি জারফ নামক স্থানে চাষাবাদ করেছেন। (আল-মাবসুত লিস সুরুখসি: ২/২৩)

নবী (সা.) বলেন, ‘আমি তোমাদের আদম (আ.) সম্পর্কে বলব—তিনি কৃষিকাজ করতেন। আমি তোমাদের ইবরাহিম (আ.) সম্পর্কে বলব—তিনি চাষবাস করতেন।’ (মুসতাদরাক হাকেম, হাদিস: ৪১৬৫)

কৃষিকাজে সাদকার সাওয়াব : ভূমি ব্যবহার করে বৃক্ষ রোপণ, বনায়ন ও ফল-ফসল উৎপাদন করে সাদকার সাওয়াব লাভ করা যায়। আনাস ইবন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, যেকোনো মুসলিম ফলবান গাছ রোপণ করে কিংবা কোনো ফসল ফলায়, আর তা থেকে পাখি কিংবা মানুষ বা চতুষ্পদ জন্তু খায় তবে তা তার পক্ষ থেকে সাদকা বলে গণ্য হবে। (বুখারি, হাদিস : ২১৬৯)

কৃষিকাজের প্রয়োজনে কুকুর পোষার বৈধতা : সাধারণত কুকুর পালন নিষেধ হলেও কৃষিকাজের প্রয়োজনে কুকুর পালন করারও অবকাশ আছে। তবু কৃষিকাজ টিকে থাক। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কুকুর প্রতিপালন করবে, প্রতিদিন তার আমলনামা থেকে এক কিরাত পরিমাণ সওয়াব কমতে থাকবে। তবে ক্ষেত খামার বা পশুপাল পাহারা দেওয়ার কাজে নিযুক্ত শিকারি কুকুর ছাড়া।’ (বুখারি, হাদিস: ২১৭১)

অমুসলিমকে জমি বর্গা দেওয়া : আর্থিক লেনদেন, ব্যবসা-বণিজ্য ও সেবার আদান-প্রদান সব ধর্মের মানুষের সঙ্গে পরিচালনা করতে কোনো বাধা নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) অনেকবার ইহুদির কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন এবং যথাসময়ে তা পরিশোধ করে দিয়েছেন। এভাবে অমুসলিমকে জায়গা-জমি বর্গা দেওয়াতেও কোনো সমস্যা নেই। ইবন উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) খায়বারের জমি ইহুদিদের এ শর্তে বর্গা দিয়েছিলেন যে তারা তাতে পরিশ্রম করে কৃষিকাজ করবে এবং উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক তারা পাবে। (বুখারি, হাদিস: ২১৮০)

যুদ্ধের সময়ও ক্ষেতখামার রক্ষার তাগিদ : ইসলামে কৃষিকাজ ও চাষাবাদের প্রতি এতই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যে যুদ্ধের সময়ও যেন ক্ষেতখামার নষ্ট না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে বলা হয়েছে। আবু বকর (রা.) তাঁর শাসনামলে সিরিয়ায় যখন সৈন্যবাহিনী পাঠান, তখন তিনি তাদের প্রতি নির্দেশ জারি করেন যে ‘তোমরা কিছুতেই কোনো ফলবান বৃক্ষ কাটবে না।’ (মুআত্তা ইমাম মালেক, হাদিস : ৯৬৫; তিরমিজি, হাদিস : ১৫৫২)

কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে রাষ্ট্রের ক্ষতিপূরণ : কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা.)। ইমাম আবু ইউসুফ (রা.) তাঁর প্রখ্যাত ‘কিতাবুল খারাজ’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘এক কৃষক ওমর (রা.)-এর কাছে অভিযোগ করেন, হে আমিরুল মুমিনিন, আমি চাষাবাদ করেছি। সিরিয়াগামী মুসলিম সৈন্যদল এই ক্ষেতের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে। (অতিক্রমের মাধ্যমে) তারা ওই ক্ষেত ধ্বংস করে দেয়। এ কথা শুনে ওমর (রা.) ক্ষতিপূরণস্বরূপ রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ১০ হাজার দিরহাম প্রদান করেন।’ (কিতাবুল খারাজ, পৃষ্ঠা ১২৯)

ইবাদত বিঘ্ন করে কৃষিকাজ না করা : কৃষিকাজ আর অর্থের মোহে পড়ে আল্লাহকে ভুলে গেলে হবে না; বরং ইসলামের মৌলিক ইবাদত-বন্দেগি যেমন—নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত যথাসময়ে আদায় করতে হবে। ইবাদতের সময় ক্ষেত-কৃষি বন্ধ রেখে ইবাদতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। যে কৃষিকাজ কৃষককে দ্বিন থেকে গাফিল করে ও সীমা লঙ্ঘনে উদ্বুদ্ধ করে—তাদের সম্পর্কে হদিসে কঠোর বাণী বর্ণিত হয়েছে। আবু উমামা বাহিলি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি লাঙলের হাল এবং কিছু কৃষি যন্ত্রপাতি দেখে বললেন, আমি নবী (সা.)-কে বলতে শুনেছি, এটা যে সম্প্রদায়ের ঘরে প্রবেশ করে, আল্লাহ সেখানে অপমান প্রবেশ করান। (বুখারি, হাদিস : ২১৭০)

পরিশেষে বলা যায়, ব্যবসা-বাণিজ্য ও প্রযুক্তিতে মানুষ যতই উৎকর্ষ সাধন করুক না কেন, চাষাবাদ ছেড়ে দিলে জীবনযাত্রা সংকুচিত হয়ে যাবে—এটাই স্বাভাবিক। নেকনিয়ত ও হালাল পদ্ধতি অবলম্বন করে এবং যথাসময়ে ইবাদত-বন্দেগি ঠিক রেখে কৃষিকাজ করলে তা নেকি অর্জনের মাধ্যমে পরিণত হবে, ইনশাআল্লাহ।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক
আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

 

Check Also

ভিসা স্থগিত করল ঢাকার কসোভো দূতাবাস

বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য কসোভোর ভিসা সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

x