ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য কর্ণাটকে স্কুল-কলেজে মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব পরা নিয়ে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি চলছে। তিনদিন স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। শিক্ষার্থীদের হিজাব পরতে না দেওয়ার কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছেন কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, পাকিস্তানের নোবেল বিজয়ী মালালা ইউসুফজাইসহ অনেকে।
উদুপির সরকারি কলেজে মেয়েদের হিজাবপরে ক্লাসে ঢোকা নিষিদ্ধ করার পর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গোলমাল শুরু হয়। উদুপিতে কলেজ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, ছাত্রীদের ড্রেস কোড মানতে হবে। কলেজের ড্রেস কোডে কোথাও হিজাব পরার কথা নেই। তাই তারা হিজাব পরতে পারবেন না। আর ছাত্রীদের দাবি, এটা তাদের ধর্মীয় অনুশাসনের অঙ্গ। তাই তাদের হিজাব পরতে দিতে হবে।
উদুপির এই বিতর্ক ক্রমশ কর্ণাটকের অন্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। কুন্দারপুতাতে একটি কলেজে কয়েকজন ছাত্রী হিজাব পরে কলেজে আসছিলেন। তার প্রতিবাদে কিছু ছাত্র গেরুয়া শাল জড়িয়ে ক্লাসে যায়। শুরু হয় বিতর্ক ও গোলমাল। কর্ণাটকের বিভিন্ন কলেজে হিজাব ও গেরুয়া শাল, স্কার্ফ বিতর্ক তীব্র হতে শুরু করে। উত্তেজনা বাড়তে থাকে। এরপরই কর্ণাটক সরকার তিনদিন রাজ্যের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এদিকে হিজাব পরার অধিকার চেয়ে ছাত্রীরা কর্ণাটক হাইকোর্টে আবেদন জানিয়েছে। বিষয়টি এখন আদালতের বিচারাধীন। বিচারপতি জানিয়েছেন, তিনি যতদিন রায় না দিচ্ছেন, ততদিন যেন রাজ্যে শান্তি বজায় থাকে। সব পক্ষ যেন ধৈর্য ধরেন।
রাজ্য সরকার জানিয়েছে, তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনো ড্রেস কোড চালু করেনি। তবে রাজ্যের নিয়মানুযায়ী, স্কুল ও কলেজ কর্তৃপক্ষ নিজস্ব ড্রেস কোড চালু করতে পারে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই ড্রেস কোড চালু আছে।
এই হিজাব বিতর্ক মধ্যপ্রদেশ ও পুদুচেরিতেও ছড়িয়েছে। মধ্যপ্রদেশের শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ”হিজাব স্কুল বা কলেজ ইউনিফর্মের অঙ্গ নয়। স্কুলে এলে ইউনিফর্ম পরে আসতে হবে। বাড়িতে যে যার মতো পোশাক পরতে পারেন।” মধ্যপ্রদেশেও সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাবকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে।
কংগ্রেস মুখপাত্র আব্বাস হাফিজ বলেছেন, ”এভাবে স্কুলে ও কলেজে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। কয়েকশ বছর ধরে মুসলিম মেয়েরা হিজাব ও শিখরা পাগড়ি পরেন। তাতে কোনো অসুবিধা হয়নি। এখন কেন হবে?” পুদুচেরিতেও একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিজাব পরতে নিষেধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে সেখানেও বিতর্ক শুরু হয়েছে।
উডুপির ছাত্র মাসুদ মুন্না জানিয়েছেন, ‘ছাত্রীদের হিজাব পরতে দেয়া হচ্ছে না। একটা ভুল ধারণা রয়েছে, ছাত্রীরা বোরখা পরে কলেজে আসছিলেন। সেটা ঠিক নয়। তারা শুধুমাত্র মাথা ঢেকে ছিলেন।” তার দাবি, ”হিজাব পরে আসতে পারবে না বা মাথা ঢাকা যাবে না, কলেজের ড্রেস কোডে এমন কোনো নিয়ম নেই। কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছে, হিজাব পরলে ধর্মীয় অসাম্য হবে। কিন্তু তার পিছনে কোনো যুক্তি নেই।” মুন্নার বক্তব্য, ”সরকারি কলেজে নিয়ম অনুসারে সবকিছু চলা উচিত। সরকার কোন আইনের বলে এই নিয়ম চালু করেছে তা বলা হোক। ছাত্রীদের ক্লাসে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। কলেজ চত্বরে তারা আসতে পারছে। ছাত্রীরা ইউনিফর্মের রঙের হিজাবই পরছে।
মুন্নার অভিযোগ, স্থানীয় বিজেপি বিধায়ক বিষয়টির রাজনীতিকরণ করছেন।
প্রবীণ সাংবাদিক সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, কর্ণাটকে এক বছর পরেই বিধানসভা নির্বাচন। মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ পুন্নিয়া কিছুদিন হলো দায়িত্ব নিয়েছেন। তারপর পুর নির্বাচনে কংগ্রেস ও জেডিএস ভালো ফল করেছে। ফলে এই বিতর্কের পিছনে রাজনীতি কাজ করছে।
তিনি মনে করেন, যা অবস্থা, তাতে মেরুকরণ না হলে বিজেপি আগামী বছর জিততে পারবে না। আর কর্ণাটক কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্য নয়, যেখানে প্রচুর মুসলিম থাকেন। তা সত্ত্বেও এই রকম বিতর্ক তুলে হিন্দু ভাবাবেগ উসকে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। এর প্রভাব উত্তরপ্রদেশের ভোটেও পড়তে পারে।
এদিকে হিজাব বিরোধীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে এক টুইট বার্তায় প্রিয়াঙ্কা গান্ধী লিখেছেন, বিকিনি হোক কিংবা ঘোমটা, জিন্স বা হিজাব হোক, তিনি কী পরতে চান তা সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রয়েছে একজন নারীর। নারীর এই অধিকার ভারতীয় সংবিধানে নিশ্চিত করা হয়েছে। নারীদের হয়রানি করা বন্ধ করুন।
পাকিস্তানির নোবেল বিজয়ী মালালা ইউসুফজাই বলেছেন, মেয়েদের হিজাব পরে ক্লাসে যেতে না দেওয়া ভয়ংকর ব্যাপার। পোশাক বাছাইয়ের প্রশ্নে নারীদের বস্তু হিসেবে দেখা অব্যাহত রয়েছে। ভারতীয় নেতাদের অবশ্যই মুসলিম নারীদের প্রান্তিককরণ বন্ধ করতে হবে।