মাওলানা ইসমাইল নাজিম:
ভ্রমণ এক আনন্দময় ইবাদত। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ভ্রমণের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহর নিদর্শন গভীরভাবে অবলোকন করতে, সৃষ্টির সৌন্দর্য দেখে স্রষ্টাকে স্মরণ করতে এবং পূর্ববর্তী অবাধ্য জাতিগুলোর পরিণাম স্বচক্ষে দেখতে ভ্রমণের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ভ্রমণ থেকে শিক্ষা অর্জনের জোর তাগিদ দিয়েছে ইসলাম।
আল্লাহর অসীম শক্তি অবলোকন করতে ভ্রমণের বিকল্প নেই। আল্লাহ মহাবিশ্ব কীভাবে সৃজন করেছেন, কত নিখুঁতভাবে পরিকল্পনা করেছেন তা ভ্রমণে বের হলেই অনুধাবন করা সম্ভব। তার অপার সৌন্দর্যভরা সৃষ্টিসম্ভার দেখলে বিজ্ঞ মানুষ মাত্রই বুঝতে সক্ষম হবেন শূন্য থেকে এত সুন্দর জগৎ সৃষ্টি করতে পারলে পরকালে নিশ্চয়ই আবার আমাদের সৃষ্টি করতে পারবেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বলুন, তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং দেখো, কীভাবে তিনি সৃষ্টিকর্ম শুরু করেছেন। অতঃপর আল্লাহ পুনর্বার সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু করতে সক্ষম। (সুরা আনকাবুত, আয়াত : ২০)
সফরের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের নানা বৈচিত্র্যময় বিষয় থেকে জীবনের পাথেয় সঞ্চয় করা যায়। ভ্রমণ করলে মানুষের চোখ-কান খুলে যায়। সত্য ও সঠিক পথে নিজেকে পরিচালিত করার অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তবে কি তারা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করে না, যাতে তাদের অন্তর অনুধাবন করতে পারত এবং তাদের কান (সত্য কথা) শুনে নিত।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৪৬)
প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ভ্রমণের প্রতি বিশেষ জোর দিয়েছেন আল্লাহতায়ালা। পূর্ববর্তী জাতিগোষ্ঠীর কীর্তি ও শক্তিমত্তার নিদর্শন অবলোকন করা এবং আল্লাহর অবাধ্যতার কারণে তাদের করুণ পরিণতি থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে আলোচিত হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না এবং তাদের পূর্ববর্তীদের কী পরিণাম হয়েছিল তা কি দেখে না? মুত্তাকিদের জন্য পরকালের জীবনই শ্রেয়। তোমরা কি বোঝো না?’ (সুরা ইউসুফ, আয়াত: ১০৯)
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘এরা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না? করলে দেখত এদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কী হয়েছিল। পৃথিবীতে তারা ছিল এদের অপেক্ষা শক্তিতে ও কীর্তিতে প্রবলতর। অতঃপর আল্লাহ তাদের কৃত অপরাধের জন্য শাস্তি দিয়েছিলেন। আল্লাহর শাস্তি থেকে তাদের রক্ষার কেউ ছিল না। (সুরা মুমিন, আয়াত: ২১)
ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম হজ। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে পবিত্র মক্কায় গিয়ে এই বিধান পালন করতে হয়। আরবি ওমরাহ শব্দের অর্থ ভ্রমণ। তাই হজ-ওমরাহর সঙ্গে রয়েছে ভ্রমণের অনিবার্যতা। ইসলামের আরেক স্তম্ভ জাকাতের আটটি খাতের কথা কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে, তন্মধ্যে একটি খাত হলো সম্বলহীন মুসাফিরকে জাকাত দেওয়া। এসব বিধান ভ্রমণের গুরুত্ব প্রমাণ করে।
ভ্রমণের মাধ্যম রাস্তাঘাট ও যানবাহন আল্লাহর নেয়ামত। কোরআনের ভাষায়, ‘তাদের ও যেসব জনপদের প্রতি আমি অনুগ্রহ করেছিলাম, যেগুলোর মধ্যবর্তী স্থানে বহু জনপদ স্থাপন করেছিলাম এবং সেসব জনপদে ভ্রমণের যথাযথ ব্যবস্থা করেছিলাম এবং তাদের বলেছিলাম, তোমরা এসব জনপদে দিনেরাতে নিরাপদে ভ্রমণ করো।’ (সুরা সাবা, আয়াত : ১৮)
ইসলামি আইনবিদদের মতে, কেউ যদি সওয়াবের নিয়তে ভ্রমণ করে, পুরো ভ্রমণেই তার সওয়াব অর্জন হবে। জ্ঞানার্জনের জন্য সপরিবারে বা দলবদ্ধভাবে ভ্রমণে যাওয়াতে কল্যাণ ও পুণ্য নিহিত রয়েছে। সব মুসলমানের জন্য আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে সামর্থ্য অনুযায়ী সফর করা কর্তব্য। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের পূর্বে বহু বিধান-ব্যবস্থা গত হয়েছে, সুতরাং তোমরা পৃথিবী ভ্রমণ করো এবং দেখো মিথ্যাশ্রয়ীদের কী পরিণাম!’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৩৭)
শীত ও গ্রীষ্মকাল ভ্রমণের আদর্শ সময়। কোরআনের বর্ণনায়, ‘কুরাইশদের অনুরাগ ও আসক্তির কারণে তারা শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন ভ্রমণ (করে)। সুতরাং তাদের উচিত এই (কাবা) ঘরের প্রভুর ইবাদত করা। যিনি ক্ষুধায় তাদের অন্ন দিয়েছেন; ভয়ের সময় দিয়েছেন নিরাপত্তা।’ (সুরা কুরাইশ, আয়াত : ১-৪)
মুমিনের ভ্রমণকে আনন্দদায়ক করতে ইসলাম বিধিবিধানে ব্যাপক ছাড় দিয়েছে। দূরের সফরে চার রাকাতবিশিষ্ট ফরজ নামাজ দুই রাকাত পড়তে বলা হয়েছে। সুন্নত নামাজকে নফলের পর্যায়ে রাখা হয়েছে। ঈদের নামাজ, জুমা ও কোরবানি শরয়ি সফরে ওয়াজিব নয়। সফরে ফরজ রোজাও না রাখার অনুমতি আছে। এভাবেই ইসলাম ভ্রমণকে আনন্দময় ইবাদতে পরিণত করেছে।
পুরো বিশ্ব-মহাবিশ্ব, ভূমণ্ডল-নভোমণ্ডল আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তাই আসুন, আল্লাহর অপার নিদর্শনে ভরা এই জগতে আমাদের সাধ্যমতো সফর করে ইমান বৃদ্ধি করি।