রাজশাহী প্রতিনিধি :- রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলায় কয়েক বছর আগেও মাঠের পর মাঠে রবিশস্যসহ ইরি-বোরোর আবাদ হতো । কৃষকের গোলায় ভরপুর থাকতো শস্য,ধান আরও কৃষান কৃষানীর মুখে থাকতো হাসি।
কিন্তু কয়েক বছর ধরে নানা কারনে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হওয়ায় বছরের পর বছর জমিতে ফসল ফলাতে পারছেন না কৃষকরা।ফলে পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তারা।
জলাবদ্ধ এলাকার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চার-পাঁচ বছর ধরেই ওই সব এলাকায় খননযন্ত্র দিয়ে কৃষিজমি ভরাট করা হচ্ছিল। কিন্তু এক-দেড় বছর ধরে অপরিকল্পিতভাবে খননযন্ত্র বসিয়ে কৃষিজমির পাশাপাশি খাল ও নালার মুখ ভরাট করার প্রবণতা শুরু হয়েছে। এ কারণে বর্তমানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এসব এলাকার জমি থেকে পানি না সরায় জমি অনাবাদি পড়ে আছে। তাঁরা আরও জানান, পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা না করলে এসব গ্রামের রবি ফসলের আবাদ ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জলাবদ্ধতা নিয়ে একদিকে কৃষকের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। অন্যদিকে শ্রেণি পরিবর্তন নিয়ে প্রশাসন রয়েছে কঠোর অবস্থানে।সরকারের তরফ থেকে জলাবদ্ধতা নিরসন করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া না হলে আর্থিক সংকট ও খাদ্যাভাব দেখা দেবে কৃষকদের মধ্যে। ভুক্তভোগী কৃষকদের কেউ কেউ কোনো উপায়ন্তর না দেখে আত্মাহুতির হুমকীও দিচ্ছেন।
১৬ জানুয়ারি জেলার দুর্গাপুর উপজেলার আংরার বিল, পদ্ম বিল, ফলিয়ার বিল ও পানানগর ইউনিয়নের রঘুনাথপুর শেখ পাড়ার বিলসহ কয়েকটি বিল সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় ৬০০ একর জমি জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে এখনো অনাবাদি অবস্থায় পতিত পড়ে আছে।
কোনো কোনো জমিতে হাটু সমান পানি জমে আছে। জমিতে জমে থাকা পানিতে হাঁস ও পাখিদের জলকেলি করতে দেখা গেছে।
তেবিলা গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক আব্দুল কুদ্দুস ও সুমনসহ বেশ কয়েকজন কৃষক বলেন, গত ৩-৪ বছর ধরে নিচু প্রকৃতির জমিগুলোতে নানা কারণে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে ফসল ফলাতে না পেরে পরিবার-পরিজন নিয়ে একদিকে যেমন খাদ্যাভাবে ভুগছেন, অন্যদিকে আর্থিক কষ্টেও ভুগছেন তারা।
জলবদ্ধতায় অনেক কৃষক জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে পুকুর খনন করছেন। তাতে মাছ উৎপাদনের পাশাপাশি বিনা খরচে বেশি লাভ পাছেন কৃষকরা। ফসল ফলাতে গিয়ে উৎপাদন খরচ উঠছে না অনেক কৃষকের।
পক্ষান্তরে একই জমিতে চাষাবাদ ছেড়ে পুকুর খনন করে তিনগুণ বেশি লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা।
কৃষক সোহাগ বলেন, জলাবদ্ধ জমিগুলো ফসল ফলানোর উপযোগী করা না হলে পরিবার পরিজন নিয়ে তাদের না খেয়ে থাকতে হবে। আর এভাবে চলতে থাকলে আত্মহত্যা করা ছাড়া তাদের কোনো উপায় থাকবে না।
এদিকে, বৈশ্বিক খাদ্য সংকট থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত রাখতে আবাদযোগ্য প্রতি ইঞ্চি জমিতে ফসল ফলাতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বছরের ১১ এপ্রিল নিজ কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়ে এ কথা বলেন সরকার প্রধান।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। এর ধাক্কাটা আমাদেরও লাগবে। আমার অফিসে যারা কাজ করেন তাদের পক্ষ থেকে এবং যারা বেসরকারি খাতে আছেন তাদের সবাইকে বলব- আমাদের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে।’
প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর কৃষক ও এই এলাকার মাছচাষীরা আশার আলো দেখলেও প্রশাসনিক বাধার মুখে সেই আলো ফিকে হয়ে আসছে এলাকার কৃষকদের চোখেমুখে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রাজিয়া সুলতানা বলেন, জলাবদ্ধ জমিগুলো পরিদর্শন করা হবে। পানি সহনীয় কিছু ফসল রয়েছে সেগুলো চাষাবাদ করার ব্যাপারে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হবে। তবে কোনো কৃষক এরুপ সমস্যা নিয়ে আবেদন করলে সরেজমিনে পরিদর্শন করে কৃষকদের পরামর্শ ও সহযোগীতা করা হবে।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আমিরুল ইসলাম বলেন, যেসব জমিগুলোতে তিন ফসলের পরিবর্তে এক ফসল হয়, আবার ৬-৮ মাস জলাবদ্ধতা অবস্থায় থাকে এরূপ জমি গুলো সংস্কার করে মাছ চাষের উপযোগী করে মাছের উৎপাদন বাড়ানো যেতে পারে।এতে করে মাছ উৎপাদন ৫-১০ ভাগ বেড়ে যাবে। অর্থনৈতিকভাবেও সমৃদ্ধ হবেন কৃষকরা।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার সোহেল রানা বলেন, এই উপজেলার বেশকিছু বিলে জলাবদ্ধ সমস্যাটা প্রকট হয়ে উঠেছে। এ ধরনের সমস্যা নিয়ে প্রায় দিনই কৃষকরা আসছেন। কিন্তু জমির শ্রেণি পরিবর্তন নিয়ে বিধিনিষেধ থাকায় চাইলেও কৃষকদের তাৎক্ষণিক কোনো পরামর্শ দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা।
তবে কৃষকদের অভিযোগ বা দাবি দাওয়া নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলেও জানান ইউএনও সোহেল রানা।
এদিকে, দুর্গাপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার প্রান্তিক কৃষক এবং জনপ্রতিনিধিদের দাবি, সরকারের পক্ষ থেকে খাল গুলো সংস্কার করে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে।
অন্যথায় শ্রেণি পরিবর্তনের অনুমতি দিয়ে পুকুর খনন করা গেলে আর্থিক ভাবেও লাভবান হবেন কৃষকরা। তাছাড়া এই এলাকার কৃষকরা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বেন এবং খাদ্য সংকটে ভুগবেন।