কম্বোডিয়ায় উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দিয়ে আদায় করে নিতো চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা। দালালদের মাধ্যমে শিক্ষিত, কম্পিউটার বিষয়ে পারদর্শী বেকার তরুণ-তরুণীদের টার্গেট করতো তারা। পরে কম্বোডিয়ায় নিয়ে যাওয়ার পর তাদের বিদেশি কোম্পানির কাছে দুই থেকে তিন হাজার ডলারে বিক্রি করে দিতো। তার এমন কাজ করা হতো এক প্রবাসী বাংলাদেশির সহায়তায়। এমন এক মানবপাচারকারী চক্রের মূলহোতাসহ তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
মঙ্গলবার (৬ সেপ্টেম্বর) দুপুরে র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে এসব তথ্য জানান।
মানবপাচার চক্রের গ্রেপ্তার সদস্যরা হলেন- চক্রের মূলহোতা নাজমুল ইসলাম (৩০), নূর ইসলাম সাজ্জাদ (২৫) ও মো. সিরাজুল ইসলাম পঞ্চায়েত (৫৭)। তাদের গ্রেপ্তারের সময় তিনটি পাসপোর্ট, চারটি মোবাইলফোন, মানবপাচার সংক্রান্ত ২৫০ পাতার বিভিন্ন কাগজপত্র ও নগদ পাঁচ হাজার ১৬ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র্যাব।
গ্রেপ্তারকৃতরা সংঘবদ্ধ মানবপাচার চক্রের সদস্য জানিয়ে আরিফ মহিউদ্দিন বলেন, এ চক্রের মূলহোতা কম্বোডিয়া প্রবাসী নাজমুল ইসলাম। তিনি বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে উচ্চ বেতনে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে চাকরি দেওয়ার নাম করে ভিকটিম এবং তাদের অভিভাবকদের প্রলুব্ধ করেন। এছাড়া দালালদের মাধ্যমেও শিক্ষিত, কম্পিউটার বিষয়ে পারদর্শী বেকার তরুণ-তরুণীদের প্রলুব্ধ করা হতো।
তিনি র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, কম্বোডিয়ায় পাঠানোর খরচ বাবদ প্রাথমিকভাবে তারা চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা নিতো এ চক্রটি। আগ্রহীদের প্রথমে কম্পিউটার বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হতো। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে কম্বোডিয়া প্রবাসী আলীম ও শরিফুলের সহায়তায় তাদের জন্য কম্বোডিয়ান ট্যুরিস্ট ই-ভিসা করা হয়। এরপর তাদের কম্বোডিয়ায় পাঠানো হয়।
কম্বোডিয়ায় যাওয়ার পর গ্রেপ্তার নাজমুল তার সহযোগী কম্বোডিয়া প্রবাসী রাকিব ও রফিকের সহায়তায় প্রথমে ভুক্তভোগীদের কম্বোডিয়া প্রবাসী আরিফের হোটেলে নিয়ে যায়। পরে তাদের কাছ থেকে পাসপোর্ট ছিনিয়ে নেওয়া হয়। হোটেলে কিছুদিন অবস্থান করার পর তাদের কম্পিউটার বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য কম্বোডিয়া প্রবাসী কামাল ওরফে লায়ন কামাল ও আতিকের সহায়তায় একটি বিদেশি ট্রেনিং সংস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়।
সেখানে বিদেশি প্রশিক্ষকরা ভুক্তভোগীদের গুগল ট্রান্সলেটরের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছদ্মনামে অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করে অন্যদের কীভাবে প্রতারণা করা যায়, ভুয়া ক্লোন ওয়েবসাইট ব্যবহার করে ক্রেডিট কার্ড থেকে টাকা আত্মসাৎ করার কৌশল, ভুয়া নম্বর থেকে ফোন দিয়ে বা চ্যাটিং করে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার নাম করে কৌশলে ডিপোজিট হাতিয়ে নেওয়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভয়েস কল ও ভিডিও কল রেকর্ডিং করে পরবর্তীসময়ে ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ আত্মসাৎ করার কৌশল শেখান। মানবপাচারকারীদের ভাষায় সাইবার প্রতারণার বিষয়টি স্ক্যামার হিসেবে পরিচিত।
তিনি আরও বলেন, এ ট্রেনিং শেষে ভুক্তভোগীদের একটি বিদেশি কোম্পানির কাছে দুই হাজার থেকে তিন হাজার ডলারে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এরপর তাদের একটি সুরক্ষিত ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। ভবনে যাওয়ার পর তাদের দেহ তল্লাশি করে সব প্রকার ইলেকট্রনিক ডিভাইস তাদের কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হয়। তারপর তাদের একটি কম্পিউটার ল্যাবে নিয়ে যাওয়া হয়। যেখানে একটি বৃহৎ কক্ষে ৩০০ থেকে ৪০০ ডেক্সটপ কম্পিউটার সাজানো থাকে। মানবপাচারকারীদের ভাষায় ল্যাবকে ক্যাসিনো বা প্ল্যাটফর্ম বলা হয়।
‘কম্পিউটার ব্যবহার করে ভুক্তভোগীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পুরুষদের সঙ্গে ছদ্মনামীয় নারী অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে এবং নারীদের সঙ্গে ছদ্মনামীয় পুরুষ অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য বাধ্য করা হয়। ভাষাগত বাধা দূর করার জন্য গুগল ট্রান্সলেটের সাহায্য নেওয়া হয়। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার পর ভিডিও কল দিয়ে আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গি ও কথাবার্তা রেকর্ড করা হয়। সে রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। আবার কখনো উপহার পাঠানো, দেখা করার জন্য যাতায়াত খরচ ইত্যাদি প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়। এসব কাজে টিকটক, বিটকয়েন ও ফেক ওয়েবসাইটের সহায়তা নেওয়া হয়।’
লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, তাদের একটি নির্দিষ্ট টার্গেট দেওয়া হতো। কেউ টার্গেট সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হলে বা কাজ করতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হতো। সেখানে তদের খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হতো। ক্যাসিনো বা প্ল্যাটফর্মগুলো কঠোর নিরাপত্তার চাদরে আবৃত্ত থাকায় ওই স্থান থেকে কারও পক্ষে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। কেউ এসব কাজ থেকে অব্যাহতি চাইলে তার কাছ থেকে তাকে কিনতে যে ডলার ব্যয় করা হয়েছে তার দ্বিগুণ অর্থ ফেরত দিতে বলা হতো। সে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে কোনো অভিযোগ করবে না বলে অঙ্গীকারনামা নেওয়া হতো।
তিনি আরও বলেন, তখন ভুক্তভোগীরা বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ থেকে টাকা সংগ্রহ করে ওই কোম্পানিতে অর্থ ফেরত দিয়ে কম্বোডিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি দালালদের আশ্রয়ে যায়। তখন দালালরা ভিকটিমদের পুনরায় আরেকটি সাইবার প্রতারক কোম্পানিতে বিক্রি করে দেয়। যদি কেউ দেশে ফিরে আসতে চায়, তখন দেশে ফেরত যাওয়ার শর্ত হিসেবে আরও গ্রাহক সংগ্রহ করে দেওয়ার শর্ত জুরে দেয়। এসময়ে ভিকটিমের কম্বোডিয়ায় থাকা খাওয়ার খরচ নিজেকে বহন করতে হয়। ভিকটিমদের কোনো রোজগার না থাকায় তারা ইচ্ছার বিরুদ্ধে অবৈধ কাজ করতে বাধ্য হয়। নতুবা দেশ থেকে টাকা নিয়ে থাকা খাওয়ার ব্যয় নির্বাহ করতে হয়।’
আরিফ বলেন, তখন ভুক্তভোগীরা নিরুপায় হয়ে নিজে মুক্তি পাওয়ার জন্য তার পরিচিত অপর বাংলাদেশিদের কম্বোডিয়ায় যেতে প্ররোচিত করে। কম্বোডিয়া প্রবাসী আলীম ও শরিফুল তাদের ই-ভিসার ব্যবস্থা করে কম্বোডিয়ায় নিয়ে ভুক্তভোগীদের একইভাবে সাইবার ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়। এভাবে এ চক্র বাংলাদেশ থেকে পাঁচ শতাধিক বাংলাদেশিকে সাইবার ক্রীতদাস হিসেবে কম্বোডিয়ায় পাচার করেছে।
তিনি বলেন, সাইবার প্রতারণার কাজে বাংলাদেশিদের ব্যবহার করার কারণ হচ্ছে কোনো বাংলাদেশি কম্বোডিয়া যাওয়ার পর তার পাসপোর্ট ছিনিয়ে নিলে তিনি পালিয়ে যেতে সক্ষম হবে না বা স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করতে সক্ষম হবে না। বাংলাদেশি ভুক্তভোগীরা উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভনে পড়ে তার পরিচিতদের মাধ্যমেই দালালদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। ভুক্তভোগীরা দেশে ফিরে বাংলাদেশি দালালদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হলেও কম্বোডিয়া প্রবাসী দালালরা থাকছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।