এবার ঈদের বেশ কয়েকটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে আমাদের প্রেক্ষাগৃহে। মুক্তি পাওয়ার আগে থেকেই এবারের সিনেমা নিয়ে বেশ আলোচনা দেখেছি সংবাদমাধ্যমসহ ফেসবুকে। আলোচনায় এগিয়ে ছিল ‘প্রিয়তমা’, ‘সুড়ঙ্গ’ ও ‘প্রহেলিকা’। এ তিন সিনেমার প্রচারে ব্যবহার করা হয়েছে অনেক কৌশল।
যেমন প্রিয়তমা সিনেমায় শাকিব খান থাকায় এমনিতেই সেটি আলোচনায় উঠে আসে। ঈদের ঠিক আগে আগে সাদা চুল-দাড়িতে শাকিব খানের একটি পোস্টারও বেশ সাড়া ফেলে। এবার তার সঙ্গে আছেন ওপার বাংলার অভিনেত্রী ইধিকা পাল।
সিনেমার প্রতি দর্শকদের আকৃষ্ট করতে নায়ক-নায়িকা বাছাই থকে শুরু করে পোস্টার, গান রিলিজ নানা কৌশল নিতে দেখা যায়। ফেসবুক ট্রলও অনেক সময় হীতে বিপরীতের মতো সিনেমার প্রচারে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
অপর দুই সিনেমার মধ্যে ‘সুড়ঙ্গ’ আলোচিত হয়েছে এর টিজার, পোস্টার এবং আফরান নিশোর কারণে। এ প্রথম নাকি তিনি বড় পর্দায় কাজ করছেন। এ সিনেমার ট্রেলার প্রকাশ না করাও নাকি কৌশলের অংশ। পাশাপাশি একটা গানও তারা ছেড়েছে সিনেমা মুক্তি পাওয়ার আগে আগে। সেটিতে নেচেছেন নুসরাত ফারিয়া। বড়দের জন্য উপযুক্ত এই গান। যাকে আইটেম সং বলা হয়।
আর ‘প্রহেলিকা’র মূল আকর্ষণ মাহফুজ আহমেদ। টিভি অভিনেতা হিসেবে যিনি বেশ জনপ্রিয় ছিলেন নব্বই এবং পরবর্তী দশকে। বড় পর্দায়ও অভিনয় করেছেন আগে। আট বছর পর তিনি যাকে বলে রূপালি পর্দায় ফিরে এসেছেন। অভিনয় করেছেন মূলধারার নায়িকা শবনম বুবলীর সঙ্গে।
কোনো সিনেমাই অবশ্য আমার দেখা হয়নি। তবে শুনেছি টিকিটও পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। বন্ধু-কলিগদের দেখলাম এর-ওপর কাছ থেকে টিকিট চাইছেন। ফেসবুক বন্ধুদেরও কেউ কেউ দেখে এসে রিভিউ দিচ্ছেন। তাদের কাছ থেকে বুঝার চেষ্টা করছি কোন সিনেমা কেমন চলছে।
এর মধ্যে রবিবার (২ জুলাই) আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড সালমা মোস্তফা নুসরাতের কথাগুলো পড়ে ভেতরে বেশ একটা নাড়াচাড়া তৈরি হলো। তিনি লেখেছেন, ‘…বাঙালি সব জায়গায় কেন যে পরিবারের সবাইকে নিয়ে যেতে চায় কে জানে? একবার একজন বলেছিল, সে নাকি পরিবারের সবাইকে নিয়ে পড়ার মতো বই লেখার ব্যাপারে আগ্রহী। বিদেশে বিভিন্ন ধরনের সিনেমা হয় এবং ওখানে গ্রেডিং করা থাকে। ওদের সব সিনেমা শিশুতোষ সিনেমা না। বাঙালি সব জায়গায় পরিবারের সবাইকে নিয়ে যেতে চায়। এ জন্য বিয়ের পর ছেলেমেয়ের যে আলাদা সময় দরকার এটা তারা বুঝে না। শিল্প, সাহিত্যের সমালোচনা বলতে বুঝে, যৌনতার সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি। এটা অনুপস্থিত থাকলেই বাঙালির ধারণা সেটা কালোত্তীর্ণ শিল্প, সাহিত্য। এরা মনে হয় এখনো প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠেনি, এখনো এটাকে উপভোগ করা শিখেনি। এই জাতি এখনো মনে হয় ‘Lady Chatterley’s Lover’ বা আল মাহমুদের ছোট গল্প ‘জলবেশ্যা’র শিল্পগুণ অনুধাবন করতে পারেনি।’
এরপর একদিনেই প্রায় দুই মিলিয়ন ভিউ পাওয়া একটি ভিডিও আমার ফেসবুকে দেখতে পাই। সেখানেও অভিযোগ পরিবারের সবার সঙ্গে দেখা যায় না এমন সিনেমা নিয়ে। এর আগেও তুমুল হই চই ফেলে দেওয়া এক সিনেমা নিয়ে এমন অভিযোগ উঠেছিল। অবশ্য সিনেমা যদি প্রাপ্তবয়স্ক হয় তাহলে এর পোস্টারে, প্রচারে ‘আঠারো প্লাস’ লেখারই নিয়ম। সিনেমার লোকজন সেই দায়িত্ব পালন না করলে তা কতটা অপরাধ এ আই্ন আমার জানা নেই। তবে বিষয়টি যে সমস্যাজনক তা অনস্বীকার্য।
এরপরও আমার মনে হয়, যারা সিনেমা দেখতে যাবেন; তাদের তো খোঁজ-খবর নিয়েই যাওয়ার কথা যে এটা শিশু অথবা পরিবারেরর সব সদস্য মিলে দেখতে পারবেন কি না। এ দায়িত্ব দর্শকদের রয়েছে। কেউ যদি মনে করেন যেকোনো সিনেমাই হবে তার পরিবারের রুচি, আদর্শ, নৈতিকতার মানদণ্ড অনুযায়ী নির্মিত হতে হবে; তাহলে তিনি ভুলই করবেন।
বাংলাদেশে শিল্প, সাহিত্য, সিনেমার বাজার বড় না। খুব ছোট। সিনেমা হল যেমন কমেছে, তেমনি বইয়ের দোকানও বন্ধ হয়েছে একের পর এক। সিনেমা হল ভেঙে গড়ে উঠেছে বিপণীবিতান, বইয়ের দোকানও বন্ধ করে পোশাক-খাবার এসবের দোকান গড়ে উঠেছে কত! অথচ কোনো দেশের নাগরিকের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হলো সিনেমা, বই পড়া, মঞ্চ নাটক দেখা-ইত্যাদি। এসবের বাণিজ্যিক দিকও রয়েছে। মানসিক শক্তি অর্জনেরও মাধ্যম এগুলো। আমাদের দেশে এর বিকাশ না ঘটার পেছনে একটা বড় কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে ‘পরিবারের সবাই মিলে’ পড়তে বা দেখতে না পারাটা। সেটা সিনেমার ক্ষেত্রে যেমন, সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তেমন।
সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে পরিবার মানে হলো নীতি, বিশ্বাস, আচার, রুচির এক শৃঙ্খলা। পরিবারকে বলা হয় সমাজের কোষ। পরিবার যেমন হবে, সমাজে সেই নীতি ও বিশ্বাসের প্রাধান্য থাকবে। যে পরিবারে উদারতা দেখা যায় সে পরিবারের সদস্যরা সন্তানদের মুক্তভাবে বেড়ে উঠতে দেন। তারা বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নিজস্ব পাঠাভ্যাস, আড্ডা, সিনেমা দেখার কাজগুলো নিজ পছন্দে করতে পারে। তবে আমাদের সমাজে বেশিরভাগ পরিবারের অভিভাবকরা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও ছেলেমেয়েদের এসব চর্চায় নিয়ন্ত্রণ জারি রাখতে চায়। এ জন্য তারা চায় যেন সিনেমাও হয় তাদের রুচিমতো, মনমতো।
জড়সড় বা আটসাট সমাজে যে কারণে শিল্প-সাহিত্যের স্ফূরণ ঘটে না। বহু মত, বহু রুচি ও বহু নীতি যদি প্রাণবন্ত পরিবেশ পায়, তাহলে শিল্প-সাহিত্য-সিনেমা নতুন বর্ষার জলের মতো ছুটে বেড়াতে পারে।
আমার ফেসবুক বন্ধুর ওই পোস্ট দেখার পর মনে পড়ল ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ সিনেমার কথা। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সাড়াজাগানো সিনেমা। পরিবারের সব সদস্য মিলে কতবার যে এ সিনেমা দেখেছেন কতজন-পরে শুনে অবাক হয়েছি। অনেকে হয়তো বাসায় বাচ্চাকে একা রেখে যেতে পারেন নাই দেখে নিয়ে গেছেন সিনেমা হলে। কেউ ভাই-বোন, মা-বাবাসহ দেখেছেন। সেই সিনেমায় গালি বা আপত্তিকর কিছু ছিল না। সাধারণ প্রেমের কাহিনি নিয়ে নির্মিত। এ ছাড়া ঘরে ঘরে ভারতীয় বাংলার অনেক সিরিয়াল দেখে থাকেন বিভিন্ন বয়সের পরিবারের সদস্যরা মিলে। বাংলা যে কোনো সিনেমা এক সময় পরিবারের সদস্যরা মিলে দেখা যেত এটা সত্য।
কিন্তু এটাও তো মানতে হবে যে, সবাই মিলে সিনেমা দেখার সেই নব-আধুনিক যুগ আর নেই। এখন যে যার পছন্দ মতো সিনেমা দেখবে। কারণ সমাজ আরো বিচিত্র হয়েছে, আরো প্রকট হয়েছে মানুষের বিভিন্ন স্বভাব। সেগুলো সিনেমা অথবা সাহিত্যে আসবেই। সেখান থেকে যে যারটা বাছাই করে দেখবে বা পড়বে।
আরেকটি সিনেমার কথা বলি-‘আগন্তুক”। এর পরিচালক সত্যজিৎ রায়। সিনেমাটি পরিবারের সব সদস্যকে নিয়ে দেখার মতোই। কিন্তু তার ‘পিকু’ সিনেমাটি পরিবারের সবাইকে নিয়ে দেখার মতো হয়তো নয়। যদিও সেই সিনেমায় একটি শিশু চরিত্র আছে। তবে সেটাকে আমাদের পরিবারের নৈতিকতার উপযোগী সিনেমা বলা যাচ্ছে না।
যে কারণে বলতে হয়, কে কোন সিনেমা দেখবেন তা আগে থেকেই ঠিক রাখতে হবে। সব সিনেমাই নিজের উপযোগী হতে হবে এমন কোনো কথা নেই।