চট্টগ্রাম-কক্সবাজারসহ দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় ঘুরে ঘুরে বেকার ও হতদরিদ্র লোকজনকে টার্গেট করতো মানবপাচার চক্রের সদস্যরা। পরে স্বল্প খরচে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলে টোপ দিত। রাজি হলেই তাদের কাছ থেকে খালি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে করতো কথিত চুক্তি। এরপর সনেওয়া হতো চুক্তির অর্ধেক টাকা। পরে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলে সাগরে তিন চার ঘণ্টা ঘুরিয়ে রাতের আধারে নামিয়ে দেওয়া হতো সেন্টমার্টিন কিংবা নির্জন কোনো দ্বীপে।
এভাবে তাদের হাতে প্রতারণার শিকার হয়েছেন তিন শতাধিক ব্যক্তি। প্রতারণার শিকার কেউ কেউ সাগরে ও নির্জন দ্বীপে করুণ মৃত্যুবরণ করেছেন বলে ধারণা করছে র্যাব।
মানবপাচারকারী এ চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। তারা হলেন— মো. ইসমাইল (৩২), শফিউল আলম (৩৭), রিয়াজ খান রাজু (৪১), মো. হোসেন (৬০) ও মো. ইউনুছ মাঝি (৫৬)।
র্যাব-৭ অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমএ ইউসুফ বলেন, ‘এ মানব পাচার চক্রের হোতারা মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলে লোকজনকে সেন্টমার্টিন কিংবা নির্জন দ্বীপে নামিয়ে দিত। পরে মানবপাচারকারীদের কাছে টাকা ফেরত চাইলে মামলা দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হতো। যাদের নির্জন দ্বীপে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের ভাগ্য কি ঘটছে নিশ্চিত করা যায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে প্রতারিতদের কেউ কেউ সাগরে এবং দ্বীপে করুণ মৃত্যুবরণ করেছে।
তিনি বলেন, ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাজু স্বীকার করেছে কমপক্ষে ২০০ জনের পাসপোর্ট তৈরি করেছে। সে হিসেবে ধারণা করছি এ চক্রের হাতে তিন শতাধিক মানুষ প্রতারিত হয়েছে। তারা নিজেরাও জানে না তারা কতজন লোকের কাছ থেকে এভাবে মালয়েশিয়া পাঠানোর কথা বলে টাকা নিয়েছে। এছাড়া কতজন এভাবে যাওয়ার সময় মারা গেছেন তারও সঠিক তথ্য নেই। তাদের কাছ থেকে ৩১টি পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে।
র্যাব জানায়- গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা এলাকায় প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত। তাদের হাতে কেউ প্রতারিত হলেও কেউ টাকা ফেরত চাইলে মারধর করতো। এমনকি কেউ টাকা দিতে না পারলে স্বাক্ষরযুক্ত স্ট্যাম্পের অজুহাতে ভিকটিমের আবাদি জমি ও বসতবাড়ি দখলে নিয়ে নিত মানবপাচার চক্রের সদস্যরা।
র্যাব-৭ এর অধিনায়ক বলেন, মানবপাচারকারী চক্রের যে পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তার মধ্যে চার জনই মূলহোতা। চক্রটি তিন ভাগে কাজ করত। প্রথমে গ্রুপের কাজ হচ্ছে, তারা অল্প খরচে মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা বলে মানুষ জোগাড় করত। দ্বিতীয় গ্রুপটি পাসপোর্ট তৈরি করত। তারা দীর্ঘদিন ধরে পাসপোর্ট তৈরি করছে। তাদের সঙ্গে পাসপোর্ট অফিসের কারও যোগাযোগ থাকতে পারে। তৃতীয় গ্রুপটি ট্রলারে করে মানুষ নিয়ে যেত। মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার জন্য দুই লাখ টাকার চুক্তি করত। এক লাখ টাকা অ্যাডভান্স নিত। বাকি টাকা মালয়েশিয়া নেওয়ার পরে দেওয়ার চুক্তি থাকত। সেখানে যাওয়ার পর পরিবার থেকে বাকি টাকা আদায় করত।
তিনি বলেন, তারা একসঙ্গে অনেক মানুষ থেকে টাকা নিত। এর মধ্যে চার-পাঁচ জনকে বৈধ পথে মালয়েশিয়া পাঠাত বিভিন্ন এজেন্ট ও লোকের মাধ্যমে। সেখানে তাদের চাকরির ব্যবস্থাও করত। তখন অন্যদের বলত আমরা কয়েকজনকে পাঠিয়েছি, তারা ভালো আছে। রেফারেন্স হিসেবে বৈধভাবে পাঠানো লোকদের নাম বলত।
টাকা নেওয়া লোকজনের মধ্যে আরেকটি গ্রুপ ট্রলারে করে মালয়েশিয়া সীমান্তে নিয়ে যেত। সেখানে বর্ডারের কাছাকাছি কোথাও নামিয়ে দিত। আর বলত জঙ্গল বা নদী পার হলে তাদের এসে নিয়ে যাবে। তারা ট্রলারে করে ৫০-৬০ জনকে নিয়ে যেত। ট্রলার থেকে নামার পরই সমস্যায় পড়ত পাচার হওয়া ব্যক্তিরা। কারণ তাদের কাছে কোনো পাসপোর্ট থাকে নেই, পথও অচেনা। এভাবে যাওয়া লোকজন মালয়েশিয়া পুলিশের হাতে আটক হতো বা জঙ্গলে আটকা পড়ত। সেখান থেকে জঙ্গল পার হয়ে চার-পাঁচ জন মালয়েশিয়া পৌঁছাতে পারত। তখন তারা পরিবারের কাছে মেসেজ দিত। তারপর বাকি টাকা এই চক্রটিকে দিত।
জানা যায়, গ্রেপ্তার হওয়া ইসমাইল হোসেন এবং শফিউল আলম সম্পর্কে সহোদর। তারা চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় ঘুরে বেকার ও দরিদ্র পরিবারের লোকজনকে স্বল্প খরচে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার টোপ দেয়। কেউ রাজি হলে খালি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে কথিত চুক্তি করে। এরপর রিয়াজ খান রাজুকে পাসপোর্ট তৈরির জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে পাসপোর্ট তৈরি করে প্রাথমিক বিশ্বাস অর্জন করে মানবপাচার চক্রের সদস্যরা।
এরপর মালেশিয়া নিয়ে যাওয়ার জন্য টার্গেটের কাছ থেকে চুক্তির অর্ধেক টাকা সংগ্রহ করে। পরে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার কথা বলে তাদের ট্রলারে তুলে দেওয়া হতো। কয়েক ঘণ্টা সাগরে ঘুরিয়ে তাদের সেন্টমার্টিন কিংবা নির্জন দ্বীপে নামিয়ে দেয়। সেন্টমার্টিনে নামিয়ে দেওয়ারা ফিরে আসলেও বাকিদের ভাগ্যে কি ঘটেছে, তা অজানা।
লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ ইউসুফ বলেন, রিয়াজ খান রাজু স্থানীয় পেকুয়া উপজেলার একজন রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি। তার ভয়ে এলাকার কেউ কথা বলার সাহস পায় না। কেউ তার বিরুদ্ধে বলতে গেলে তাকে বাড়ি ছাড়া করে দেয়। এ কারণে কেউ থানায় অভিযোগ পর্যন্ত করার সাহস পায় না। সে পাসপোর্টের দালাল। বিভিন্ন জনের সঙ্গে পরিচয় থাকায় সে সহজেই পাসপোর্ট করে দিতে পারে। রাজুর কাছেই মালয়েশিয়া যেতে আগ্রহীরা টাকা জমা দিত। তার আগে স্ট্যাম্পের মাধ্যমে চুক্তি করত। টাকা রাজুর কাছে জমা রাখত।
তিনি বলেন, রাজু সরকারি দলের একটি অঙ্গ সংগঠনের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানতে পরেছি। রিয়াজ খান রাজু শুধু এক ব্যক্তির সঙ্গেই এরকম প্রতারণা করেনি। সে তার আশপাশের এলাকার আরও অনেক মানুষের সঙ্গে একইভাবে প্রতারণা করেছে। রাজু ১০ বছর ধরে পাসপোর্ট তৈরির কাজের সঙ্গে জড়িত। এ কাজে পাসপোর্ট অফিসের কেউ জড়িত কি না তা জানতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। রাজু পেকুয়া উপজেলার রাজা খালী ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি।