রাজধানীর উত্তর মুগদায় ১০ মাস ধরে বাবা-মায়ের বাসায় গৃহবন্দি থাকা কানাডিয়ান বংশোদ্ভূত তরুণীকে দেশটির সরকারের প্রতিনিধিদের হাতে তুলে দেয়ার আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
রোববার (১৭ এপ্রিল) হাইকোর্টের বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ও আদেশ দেন। হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার মো. গোলাম রব্বানীকে আজই (রোববার) ওই তরুণীকে কানাডিয়ান হাইকমিশনে পৌঁছে দিতে বলা হয়েছে।
আদালতে আজ রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার সারা হোসেন। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম (জেড আই) খান পান্না। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী মো. শাহীনুজ্জামান ও আয়েশা আক্তার। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সমরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস।
ওই তরুণীর বাবা-মায়ের পক্ষে শুনানিত ছিলেন আইনজীবী অজিউল্লাহ। তাকে সহযোগিতার জন্য ছিলেন আইনজীবী অ্যাডভোকেট আজিম উদ্দীন পাটোয়ারি। এছাড়া আদালতে উপস্থিত ছিলেন কানাডিয়ান হাইকমিশনের প্রতিনিধিসহ কানাডার একটি মানবাধিকার সংস্থার প্রতিনিধি। বাবা-মা সহ ওই তরুণীও আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
গত ১০ মাস ধরে বাবা-মায়ের বাসায় গৃহবন্দি থাকা ওই তরুণী এখন কানাডিয়ান হাইকমিশনে থাকবেন। সেখান থেকেই সব প্রক্রিয়া শেষ করে কানাডা যাবেন তিনি। এর আগে ওই তরুণীকে দূতাবাসের কাছে হস্তান্তরের জন্য কানাডা সরকারের পক্ষে আবেদন করে দুটি মানবাধিকার সংস্থা।
গত ১২ এপ্রিল রাজধানীর উত্তর মুগদায় বাবা-মায়ের বাসায় বন্দি রাখার অভিযোগে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক ওই তরুণীকে আদালতে উপস্থিত করার জন্য বলেছিলেন হাইকোর্ট। নির্দেশ অনুযায়ী আজ সকালে মেয়েকে নিয়ে বাবা আদালতে উপস্থিত হন। এরপর এ বিষয়ে শুনানি হয়।
তলব ছাড়াও গত ১২ এপ্রিল আদালত কিছু পর্যবেক্ষণ দেন। তাতে বলা হয়েছিল, তরুণী যদি কানাডা যেতে চান তাকে বাধা দেওয়া যাবে না। আর লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে সেখানে যাওয়ার পর তরুণীর নিরাপত্তা কানাডিয়ান সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে।
আদালতে ওইদিন রিটকারী আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন তরুণীর পাসপোর্ট জমা ও তরুণীকে কানাডা হাইকমিশনে উপস্থিত করার লিখিত আবেদন জানান।
ওইদিন (১২ এপ্রিল) রিটকারী আইনজীবী ও কানাডিয়ান সরকারের প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে আদালত বলেছিলেন, ওই তরুণী কানাডা গেলে কোথায় থাকবেন, তার পড়ালেখার খরচ কে বহন করবেন- কানাডা সরকারের সঙ্গে কথা বলে আমাদের জানান।
এসময় তরুণীর বাবা আদালতে জানান, মেয়ে কানাডা গেলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে, আমার মেয়ের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বিচারপতিদের সঙ্গে একান্তে পাঁচ মিনিট কথা বলতে চাই। তখন আদালত বলেন, আমরা আপনাদের কথা শুনবো। মেয়ের কথা আগামীকাল আবারও শুনবো।
আদালত বলেন, কানাডায় আপনার মেয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই আমরা আদেশ দেবো। আমরা আগেই বলেছি, বাবা-মায়ের থেকে সন্তানের বড় শুভাকাঙ্ক্ষী কেউ হতে পারে না। পরে আদালত ওই তরুণীকে আবারও হাজির করতে বলেন।
এর আগে ৫ এপ্রিল ওই তরুণী ও তার বাবা-মাকে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। ১০ এপ্রিল দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে তাদের হাজির করতে মুগদা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বলা হয়। একই সঙ্গে তরুণীর অসম্মতিতে তাকে ঘরের ভেতর আটক রাখা কেন অবৈধ ও বেআইনি হবে না, তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করেন আদালত।
তারই আলোকে গত ১০ এপ্রিল ওই তরুণীসহ বাবা মাকে হাইকোর্টে হাজির করা হয়। ওইদিন তাকে কম্পিউটার, ইন্টারনেট, মোবাইলসহ প্রয়োজনীয় সব কিছু দিতে বলেন আদালত।
ওইদিন আদালত বলেন, কানাডার যে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছেন সেখানে সেশন ফি পরিশোধ করে আবারও অধ্যয়নের ব্যবস্থা করতে হবে। আপনারা (বাবা-মা) তার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখবেন। কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবেন না। এ বিষয়ে পরবর্তী আদেশ ও শুনানির জন্য দিন ঠিক করেন আদালত।
গত ৫ এপ্রিল বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনেন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ও আইন শালিস কেন্দ্র। আদালতে সেদিন রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম (জেড আই) খান পান্না ও ব্যারিস্টার সারা হোসেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সমরেন্দ্র নাথ বিশ্বাস। এছাড়া শুনানির সময় কানাডিয়ান হাইকমিশনের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
জানা গেছে, ওই তরুণীর জন্ম কানাডায়। তিনি জন্মসূত্রে দেশটির নাগরিক। কানাডার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন। তার বাবা-মাও কানাডায় থাকতেন। গত বছরের মার্চ মাসে তার বাবা-মা বেড়ানোর কথা বলে তাকে নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। এরপর ওই তরুণী কানাডায় ফিরে যেতে চাইলেও তাকে যেতে দেওয়া হয়নি।
রিট আবেদনে বলা হয়েছে, তরুণীর কাছ থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে তাকে তার নানি ও মা সবসময় বাসায় তালাবদ্ধ করে রাখেন। একপর্যায়ে ওই তরুণী গোপনে ই-মেইল করে কানাডা সরকার ও ঢাকাস্থ কানাডিয়ান হাইকমিশনকে তাকে জোর পূর্বক ঘরবন্দি করে রাখার কথা অবহিত করেন। ওই তরুণী কানাডায় ফিরে যাওয়ারও ইচ্ছা পোষণ করেন।
গত ৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মুগদা থানায় কানাডিয়ান হাইকমিশন থেকে সাধারণ ডায়েরি করা হয়। তারপর ওইদিনই কানাডিয়ান হাইকমিশনের পক্ষে এ সংক্রান্ত চিঠি পেয়ে মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিস (ব্লাস্ট) এবং আইন ও শালিস কেন্দ্রের সহযোগিতায় হাইকোর্টে রিট করা হয়।
রিটে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি), ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার, মুগদা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), ওই তরুণীর বাবা-মাকে বিবাদী করা হয়েছে। ওই রিটের শুনানি নিয়ে আদালত ওই তরুণীসহ বাবা-মাকে তলব করে এই আদেশ দেন।