ঢাবিতে গত ১৫ বছরে ২ হাজার শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি: নিয়মভাঙার খোঁজে নেমেছে প্রশাসন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৫ বছরে (২০০৯–২০২৪) দুই হাজারের বেশি শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি পেয়েছেন। এসব নিয়োগ ও পদোন্নতির পেছনে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগ উঠেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেন, এবং তার নেতৃত্বাধীন নতুন প্রশাসন নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম তদন্তে সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করেছে।
তদন্ত শুরু, নজর বিগত ১৫ বছরের রেকর্ডে
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইতোমধ্যে একটি পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, যেটির নেতৃত্বে রয়েছেন ঢাবির রসায়ন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও সিন্ডিকেট সদস্য ড. তাজমেরী এস এ ইসলাম। কমিটিতে আছেন আরও চারজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক ও প্রশাসনিক সদস্য, যারা ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগ খতিয়ে দেখছেন।
কমিটি ইতোমধ্যে প্রতিটি অনুষদ ও ইনস্টিটিউটে চিঠি পাঠিয়েছে এবং ব্যক্তি পর্যায় থেকেও অভিযোগ গ্রহণ করছে। তদন্তে উঠে আসা অনিয়মগুলো নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, অনেক নিয়োগেই বিজ্ঞপ্তির শর্ত পূরণ না করে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, কোথাও চারটি প্রথম শ্রেণির প্রয়োজনীয়তা থাকলেও নেওয়া হয়েছে তিনটি থাকায়, আবার কোথাও মেধা তালিকা উপেক্ষা করে পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
২০০৯–১৭: অনিয়মের ‘অঘোষিত স্বর্ণযুগ’?
বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের উপাচার্য থাকাকালে (২০০৯–২০১৭) সবচেয়ে বেশি নিয়োগ ও পদোন্নতি দেওয়া হয়, যার সংখ্যা প্রায় ১,৩৪৬ জন। পরবর্তী সাত বছরে (২০১৭–২০২৪) নিয়োগ ও পদোন্নতির সংখ্যা ৮৫০ এর বেশি। সব মিলিয়ে ১৫ বছরে মোট নিয়োগ-পদোন্নতির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২,১৯৬ জনে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ চারটি ধাপে হয়, প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক। প্রভাষক পদে সরাসরি নিয়োগ, বাকি তিনটিতে পদোন্নতির পাশাপাশি কখনো কখনো সরাসরি নিয়োগও হয়ে থাকে। তবে, পদোন্নতির সংখ্যাই তুলনামূলকভাবে বেশি।
শাস্তির আওতায় আসতে পারে ‘দোষীদের’ নিয়োগ
তদন্ত কমিটির সদস্যরা জানিয়েছেন, অনিয়ম প্রমাণিত হলে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ আসতে পারে। সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে নিয়োগ বাতিলের বিষয়টি আলোচনা পর্যায়ে রয়েছে। তবে এখনই এ বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলেননি কেউ।
ড. তাজমেরী ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন,
“চিঠি দেওয়া হয়েছে প্রতিটি অনুষদে। ব্যক্তিগতভাবেও কেউ চাইলে অভিযোগ জানাতে পারবে। অভিযোগে যেমন এসেছে, কারো ফার্স্ট ক্লাস কম ছিল, তবু নিয়োগ পেয়েছেন। মেধাক্রম উপেক্ষা করে পছন্দের লোকদের তোলা হয়েছে। এসবই আমরা যাচাই করছি।”
সাদা দলও চালাচ্ছে পৃথক তদন্ত
এছাড়াও, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয়তাবাদী শিক্ষকদের সংগঠন ‘সাদা দল’ জানুয়ারি মাসে নিজস্ব তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই কমিটিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন আইবিএ’র অধ্যাপক ড. মো. মহিউদ্দিন। তাঁরা গত ১৫ বছরে শিক্ষক নিয়োগে বৈষম্য ও অনিয়মের তথ্য সংগ্রহ করছেন।
একইভাবে, সাদা দলের আরেকটি তথ্যানুসন্ধান কমিটি শিক্ষার্থী নিপীড়নের ঘটনাও খতিয়ে দেখছে। এতে আহ্বায়ক হিসেবে রয়েছেন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান।
চলমান তদন্তে প্রশাসনের ‘শক্ত অবস্থান’
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র বলছে, তদন্ত কমিটি প্রয়োজন হলে আইনজ্ঞদের পরামর্শও নিচ্ছে এবং রিপোর্ট সিন্ডিকেটে তোলা হবে। অনিয়মকারীদের শাস্তির বিষয়ে প্রশাসন দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে।
কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
“আমরা তথ্য বিশ্লেষণ করছি এবং প্রয়োজনে আইনিভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করব। নিয়োগ বাতিলও হতে পারে, যদি অনিয়ম প্রমাণিত হয়।”
(তথ্যসমূহ সংগৃহীত ও পরিমার্জিত)