মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলাভাষা। বুকের রক্তে কেনা মাতৃভাষা বাংলা আমাদের গর্ব। কিন্ত সেই গর্ব আমরা কতটুকু হৃদয়ে ধারণ করতে পারছি, এ প্রশ্ন রয়েই যায়। কেননা বিশ্বায়নের এই সময়ে চারপাশে যেভাবে ভাষার বিকৃতি চলছে, তা থেকে বাংলাকে সুরক্ষা করতে পারছি কই?
প্রয়াত কথাসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বাংলাভাষার রাজধানী হবে বাংলাদেশ। জীবদ্দশাতেই তিনি দেখতে পান বাংলাভাষার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি মূলধারা স্থানান্তর হচ্ছে কলকাতা থেকে ঢাকাতে। কেবল কলকাতাই নয়, পুরো পশ্চিমবঙ্গে বাংলা এখন অস্তিত্বের সংকটে। হিন্দি আর ইংরেজি মিলিয়ে এক উদ্ভট বাংলার প্রসার বাড়ছে সেখোনে।
বাংলা ভাষার বাড়াবাড়ি বিকৃতিতে বিরক্ত হয়ে পশ্চিমবঙ্গের লেখক ও মানবাধিকার কর্মী ড. পার্থ ব্যানার্জির স্বীকার করে নেন, বাংলাদেশ যতদিন বিশ্বে সরব থাকবে ততদিনই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি বহাল থাকবে। কলকাতা কিংবা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে বাংলা রক্ষায় আন্তরিকতা তেমন একটি নেই। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডটি হারিয়ে গেলে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির অস্তিত্ব আর থাকবে না। পশ্চিমবঙ্গে আমরা যারা রয়েছি, তারা ক্রমান্বয়ে কর্পোরেট কালচারে ধাবিত হচ্ছি। শেকড়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হচ্ছে দ্রুতগতিতে।
পশ্চিমবঙ্গের এই বিশ্লেষকের সঙ্গে অনেকটাই একমত ভাষবিদরা। সেই সঙ্গে তারা মনে করছেন বাংলাদেশেও বাংলা ভাষার চর্চা কোথায় যেন থমকে গেছে। বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার বদলে আমরা যেন জাতি হিসেবে তাকে বিকৃতির জন্য প্রতিযোগিতায় নেমেছি। ইংরেজি ভাষার ধরনে বাংলা ভাষা বলার প্রবণতা, যাকে বহুবার ‘বাংলিশ’ বলে ব্যঙ্গ করা হয়েছে, তাতেও কারও টনক নড়েনি। বরং বাংলিশ ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা নিয়ে এক ধরনের ইয়ার্কি করার প্রবণতাও লক্ষ করা যাচ্ছে।
বাংলা ভাষার দশা আজ ধেকে ৩০ বছর পর কেমন হবে তা নিয়ে শিক্ষিতজনের মনে নানা উদ্বেগ। এই উদ্বেগের পেছনে আছে পড়ার সংস্কৃতির অবক্ষয় এবং ভাষার মানে টান পড়া। একসময় বই পড়াটা ছিল অনেকের কাছেই অভ্যাসের বিষয়। পরিবারগুলোর সংগ্রহে থাকত বই, বন্ধুবান্ধব-সহপাঠীদের মধ্যে আদান-প্রদান হতো বই। অনেক স্কুলেই গ্রন্থাগার ছিল, শিক্ষাক্রম ছিল বইবান্ধব। এখন বই পড়াটা চলে গেছে টিভি দেখা, ইন্টারনেট ঘাঁটা আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ঘুরে বেড়ানোর চর্চার পেছনে। যারা বই পড়ছে, তাদের একটা বড় অংশ পড়ছে জনপ্রিয় সাহিত্যের ফাঁদে। জনপ্রিয় সাহিত্যের চমক আছে, স্থায়িত্ব নেই; মনকে তা আনন্দ দেয়, চিন্তাকে খোরাক দেয় না।
দুর্ভাগ্যজনক হল, কলকাতার মতো বাংলাদেশেও ভাষার বিকৃতি ঠেকানো যাচ্ছে না। আমাদের নতুন প্রজন্মের কথাবার্তায় মাতৃভাষা গুরুত্ব পাচ্ছে না। ইংরেজি ভাষার ধরনে বাংলা ভাষা বলার প্রবণতা, যাকে বহুবার ‘বাংলিশ’ বলে ব্যঙ্গ করা হয়েছে, তাতেও কারও টনক নড়েনি। বরং বাংলিশ ব্যবহারের সঙ্গে বাংলা ভাষাকে হেয় করার প্রবণতা শুরু হয়েছে। এটি বেশি চোখে পড়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। বাংলিশ চর্চা ওঠে এসেছে গণমাধ্যমেও। টিভিনাটকে ভাষার বিকৃতি যোগ কয়েকজন নাট্যকার ও নির্মাতা সন্ধান পেয়েছে সাফল্য আর স্বার্থকতার।
এদেশের মানুষ বুকের রক্ত ঢেলে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষায় করেছিল। বাঙালির সেই আত্মত্যাগ আজ বিশ্ব ইতিহাসের এক সোনালি অধ্যায়। এ আত্মত্যাগ মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বিশ্ব সমাজকেও অনুপ্রাণিত করেছে। সালাম, জব্বার, বরকত, রফিকসহ শহীদদের রক্তে লেখা ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি সারা দুনিয়ায় পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। রক্ত দিয়ে বাঙালিরা মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার অর্জন করলেও ভাষা আন্দোলনের সাড়ে ছয় দশক পর প্রশ্ন উঠছে বাংলা ভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে আমরা কতটুকু তৎপর?
বাংলা ভাষা বাংলাদেশের সংবিধান স্বীকৃত রাষ্ট্রভাষা। এ ভাষার রয়েছে নিজস্ব বর্ণমালা। বাংলা সাহিত্যসম্ভার নিঃসন্দেহে বিশ্বমানের। এ সবকিছুই বাংলা ভাষার জন্য ইতিবাচক উপাদান। এ ছাড়া সারা বিশ্বে বর্তমানে বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি। এর মধ্যে বাংলাদেশে ১৬ কোটি; ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা মিলিয়ে ১২ কোটি এবং পৃথিবীময় ছড়িয়ে থাকা বাঙালির সংখ্যা কম-বেশি এক থেকে দেড় কোটি। এই বিপুলসংখ্যক ভাষী নিয়ে একটি ভাষার টিকে থাকা অত্যন্ত সংগত ও ইতিবাচক। যেখানে শত শত ভাষা নিজস্ব ভাষী হারিয়ে বিপন্নতার মুখোমুখি, সেখানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জয়জয়কার সর্বত্র। এত অর্জনের পরও আমাদের ভালোবাসার বাংলা ভাষা তার স্বকীয়তা হারাচ্ছে দিন দিন। এর জন্য মূলত দায়ী আমরাই।
এ অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে হলে সরকারকেই শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে। তা না হলে এই আত্মঘাতী ভূমিকার জন্য বাংলা ভাষা যেমন বিকৃতির গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না, তেমনি বিলুপ্তির ঝুঁকি নিয়ে শহীদদের জীবনদানকেও বৃথা করে তুলবে। সরকারের পাশাপাশি ভাষার বিকৃতি রোধে সব মানুষকে সচেতন হতে হবে এখনই।