Thursday , 9 May 2024
শিরোনাম

কলার ছড়ি দুইটা নেন মামা হাতেই কলা বিক্রি করে চলে মায়ের চিকিৎসা

রাজশাহী প্রতিনিধি:- রাত তখন ১১ টা। রাজশাহী নগরীর সাহেব বাজারের ব্যস্ততম জিরোপয়েন্ট মোড় অনেকটা ফাঁকা। কিছুক্ষণ পরে শুনসান নিরবতা নামবে রাতের গহিনে। রাতের অমোঘ ঘুমে শহরের হাজারো মানুষ এরই মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছেন। দিনের ব্যস্ততম জিরোপয়েন্টের ফুটপাতেও ঘুমিয়ে পড়েছেন কয়েকজন ভিখারী। যারা ভোরের আলোফোটার সঙ্গে সঙ্গে নেমে পড়বেন রাস্তায় থালা হাতে মানুষের কাছে টাকার জন্য হাত পাততে। কিন্তু এখনো দু’চোখে ঘুমের রেশমাত্র নাই সোয়েবের।

এরই মধ্যে দিনভর হাতে করে তরকারির কলা (স্থানীয় ভাষায় আনাজি কলা) বিক্রি করে আয় হয়েছে মাত্র পৌনে দুই’শ টাকা। আরও ২-৩ ছড়ি কলা রয়ে গেছে সোয়েবের। কিন্তু সকাল হলেই বাড়ি ফিরতে হবে তাঁকে। মায়ের জন্য ওষুধ কিনে নিয়ে যেতে হবে। এনজিও’র কিস্তির টাকাও দিতে হবে। এর পর গ্রাম ঘুরে কলা কিনে পরের দিন সকাল সকাল আবার শহরে এসে হেঁটে হেঁটে হাতে করে কলা বিক্রি করতে হবে। এসব চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুমাতে পারেননি সোয়েব। তাই রাত ১১ টা বাজলেও সেদিকে যেন খেয়ালই নাই তাঁর।
বাকি কলাগুলো বিক্রি করতেই হবে তাঁকে পথচারির কাছে। সেই আশায় ঘুম ফেলে সাহেব বাজারের রাস্তায় দুই ছড়ি (থোকা) কলা দু’হাতে নিয়ে ঘুরছেন তিনি। গায়ে ছেঁড়া ফাটা সোয়েটার। শহরের আগুন্তুক দেখে মনে করতে পারেন হয়তো পাগল ঘুরছে এতো রাতে রাস্তায়। কিন্তু সাহেব বাজারকেন্দ্রীক যাদের চলা-ফেরা তারা ঠিকই ধরে নিবেন চুল-দাড়ি আধা পাকা মাঝারি গড়নের সোয়েব কলা বিক্রির জন্য তখনো ঘুরছেন সাহেব বাজারের পথে।

বুধবার রাতে হাতে কলা নিয়ে ঘুরার সময় সোয়েবের সঙ্গে দেখা হয় এই প্রতিবেদকের। প্রতিবেদককে দেখে তিনি বলেন, ‘দুই ছড়ি কলা বিক্রি করবো মামা। দিনে ১০০ টাকায় বিক্রি করেছি দুই ছড়ি। এখন ৮০ টাকা দিলেই হবে। সকালে বাড়ি যাবো। মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে হবে। কলার ছড়ি দুইটা নেন মামা।’

সোয়েব পরে এই প্রতিবেদককে জানান, প্রায় ৩০ বছর আগে তাঁরা বাবা মারা গেছেন। তখন থেকেই সংসারের হাল ধরতে রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার মাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা সোয়েব আশে-পাশের গ্রাম থেকে তরকারিতে খাওয়া আনাজি কলা কিনে নিয়ে এসে রাজশাহী শহরের জিরোপয়েন্ট এলাকায় ঘুরে ঘুরে হাতে করে কলা বিক্রি করেন। কলার কাদি থেকে একেকটি থোকা কেটে দুই হাতে করে নিয়ে তিনি রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বিক্রি করেন। শীত-গরম, বর্ষা নাই। সারা বছর সোয়েব হাতে করে কলা বিক্রি করে থাকেন এই শহরের জিরোপয়েন্ট এলাকায়। যারা সোয়েবকে চেনেন, তাঁরা তাঁর নিকট থেকেই কলা কিনেন। যেন সোয়েবের দুই টাকা আয় হয়। আর দিনভর ঘুরে ঘুরে কলা বিক্রি করে ২৫০-৪০০ টাকা পর্যন্ত আয় হয় তাঁর। সেই আয় দিয়ে এখন চলছে সোয়েবের সংসার আর মায়ের চিকিৎসা।
সোয়েব বলেন, ‘আমার দুই ছেলে দুই মেয়ে। এর মধ্যে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। ছোট মেয়েটার বিয়ে দেয়ার ৫ বছর হয়ে গেল। ওই বিয়ের সময় এনজিও থেকে ঋণ নিছুনু। সেই টাকার জের এখনো শোধ করতে পারিনি। সারাদিন কলা বিক্রি করে যা আয় হয় সপ্তাহের কিস্তি, মায়ের ওষুধ কিনতেই শেষ হয়ে যায় বেশি। এর পর যা কিছু থাকে ওইটা দিয়ে কুনমতে সংসার চলে বাপ।’

সোয়েব বলেন, ‘বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে এই যে কলা বিক্রি করে চলছি। এখনো চলছি। জীবনের কোনো উন্নতি হয়নি। সংসারটাই শুধু টেনে নিয়ে যাচ্ছি। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। এখনো ঘরে দুই ৯ আর ৬ বছরের দুই ছেলে আছে। ওরা গ্রামের স্কুলে যায়। তেমন খরচ হয় না। কিন্তু সংসার চলাতে খুব কষ্ট হয়। গ্রাম থেকে কলা কিনে নিয়ে এসে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে এখন দিনে সর্বোচ্চ আয় হয় ৪০০ টাকা। এই দিয়েই চলছে সংসার। আমাকে এই শহরের যারা চিনেন, তারাই কলা কিনেন। তাদের প্রতি আমি অনেক ঋণি। অনেক চাক দোকানদারও আমার নিকট থেকে টাকা নেন না আমার কষ্ট দেখে। কেউ কেউ দুই-চার টাকা বেশি দেন। তাই চলে সংসার। না হলে প্যারালাইসড হওয়া মায়ের ওষুধও কিনতে পারতুক না, কিস্তির টাকাও জোগাড় হবে না, আবার সংসারও চালাতে পারব না।’

সোয়েব জানান, কাক ডাকা ভোর থেকে প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে কলা বিক্রি করে সাহেব বাজার সোনাদিঘী মোড়ের দোকানের পাশে গলি মশারি টাঙ্গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। কলা ফুরিয়ে গেলেই দুই-একদিন পর পর বাড়ি জানান। এর পর গ্রাম থেকে কলা কিনে শহরে ফিরেন।

সোয়েব বলেন, ‘আমার বৃদ্ধ মায়ের ৬০-৬৫। কিন্তু সরকারিভাবে তিনি কোনো সহযোগিতা পান না। ভোটার কার্ড করা নাই, তাই তাঁকে কেউ সহযোগিতা দেয় না। আমি শহরে কলা বিক্রির ঝামেলায় থাকি, তাই মায়ের কার্ড করা হয়নি।’

এই প্রতিবেদকের সঙ্গে সোয়েব কথা বলার সময় এগিয়ে আসেন জিরোপয়েন্টের চা-দোকানদার শাহিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘উনাকে সেই ২৫-৩০ বছর দেখছি এভাবেই হাতে করে কলা বিক্রি করতে। খুবই ভালো মনের মানুষ তিনি। কিন্তু এই মানুষটার ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন দেখলাম না। বছরের পর বছর ধরে যেভাবে কষ্ট করে যাচ্ছেন, সেটি আমরা যারা দেখছি, তারাই কেবল উপলব্ধি করতে পারি।’

আরেক দোকানদার মঞ্জুর রহমান সোয়েবকে দেখিয়ে বলেন, ‘উনি যখন শহরে আসেন, তখন বয়স কত হবে, বারো কি তেরো। সেই হিসেবে এখন তাঁর বয়স বড় জোর ৫০ বছর। কিন্তু এই বয়সেই চুল-দাড়ি পেকে গেছে তাঁর। দেখেও বৃদ্ধ মনে হয়। আসলে কঠোর পরিশ্রমেই লোকটার আজ এই অবস্থা। তাঁর পাশে দাঁড়ানো দরকার সরকারের।

Check Also

নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ঈশ্বরগঞ্জের ইউএনও আরিফুল ইসলাম প্রিন্স সড়ক দূর্ঘটনায় গুরুতর আহত

নিজস্ব প্রতিবেদক । ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) আরিফুল ইসলাম প্রিন্স নির্বাচনী দায়িত্ব পালন …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

x