ঢাকা , বুধবার, ০৪ জুন ২০২৫, ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আমার শিক্ষক

সাংবাদিক

৩০ মে। আমাদের পরিবারের জন্য দিনটি সবচেয়ে বেদনাদায়ক। এই দিনে বাংলাদেশের বহু মানুষ যেমন তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে হারিয়েছিল, তেমনি আমরা দুই ভাই হয়েছিলাম এতিম। একুশ বছর আগে এই দিনের কথা দীর্ঘ সময় ধরে যতবারই মনে হয়েছে, ততবারই শোকে বেদনায় ভারি হয়েছে হৃদয়। আজ আমিও এক সন্তানের জনক। কিন্তু এই দিনটি ক্যালেন্ডারের পাতায় ঘুরে এলে ফিরে যাই একুশ বছর আগের সেই দিনে। নিজেকে এতিম, অসহায় সেই কিশোরই মনে হয়। জীবনের স্মৃতি আবছা হয়ে গেছে। একমাত্র এই দিনের স্মৃতি মনের মধ্যে আছে পরিষ্কার স্পষ্ট। আমার বিশ্বাস, আমি, আমার ভাই এবং আরও যারা আছেন আমাদের মতো পিতৃহারা, একমাত্র তারাই এই ব্যথা অনুভব করতে পারবেন। ১৯৮১ সালের পর ৩০ মে বহুবার এসেছে জীবনে। যতদিন বেঁচে থাকব, ঘুরে ঘুরে প্রতি বছর দিনটি আসবে। কিন্তু আমরা তো কখনো ১৯৮১ সালের ২৯ মে’তে ফিরে যেতে পারব না। ৩০ মে’র পর যখন দেখলাম লাখ লাখ মানুষ চোখের পানি নিয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে একটি কফিনের পেছনে দাঁড়িয়ে তাদের নেতাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন, তখন শুধু এটুকুই মনে হয়েছিল, একটি মানুষ কীভাবে এত লাখো কোটি মানুষ আপন করে নিতে পারেন, কেমন করে পারেন কোটি মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিতে। সেই লাখো কোটি মানুষের প্রিয় জিয়াউর রহমানের সন্তান আমি, এটি মনে হলে বাবাকে হারানোর ব্যথা একটু হলেও লাঘব হয়। যখন মনে পড়ে, লাখ লাখ লোক জানাজায় এবং রেডিও টিভির সামনে বসে কোটি কোটি মানুষ আল্লাহর দরবারে তাদের প্রিয় মানুষটির জন্য দোয়া করছেন, তখন পিতার মৃত্যুর বেদনা অল্প হলেও প্রশমিত হয়। আজও মনে পড়ে জানাজার দিনের সেই অচেনা মুরুব্বির কথা, তিনি বলেছিলেন, ‘বাবা, কাঁদতে নেই; দেখ লাখ লাখ মানুষ এসেছে এই জানাজায়। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমার বাবাকে বেহেশত নসিব করবেন; তোমরা কাঁদলে তোমার বাবার আত্মা কষ্ট পাবে।’ আজও যখন বাদ জুমা বাবার কবর জিয়ারতে যাই, একজন মানুষ হলেও পাই সেখানে সেই সময়ে, যে তার নেতার জন্য দুহাত তুলে দোয়া করছে। যাকে আগে কোনোদিন দেখিনি; হয়তো আর কোনোদিন দেখবও না। আসলে এত মানুষের দোয়ার জন্য আজও মাঝে মাঝে মনে হয় বাবা আমাদের মধ্যেই আছেন, হয়তো অফিসে গেছেন, কাজ শেষ হলেই চলে আসবেন। যেমন মনে হয়েছিল ২৯ মে ১৯৮১ সালে। আমার বাবা যখন মারা যান, তখন আমার বয়স ১৪-১৫ বছর। অর্থাৎ যে সময় একজন কিশোরের জীবনের পথ চলতে শেখার জন্য দরকার তার জীবনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য শিক্ষককে, অর্থাৎ তার বাবাকে। কিন্তু আমার এবং ভাইয়ের কারও এই শিক্ষকের কাছ থেকে সরাসরি বেশি কিছু শেখার অবকাশ হয়নি। তার প্রধান কারণ, আমাদের এই শিক্ষকের কাঁধে ন্যস্ত ছিল সেই সময়ে সমগ্র দেশ ও জনগণের গুরুদায়িত্ব। তাই জীবনের পরবর্তী সময়ে আমাদের শিখতে হয়েছে এই শিক্ষকের রেখে যাওয়া সততা থেকে, শিখতে হয়েছে তার রেখে যাওয়া আদর্শ থেকে এবং সেই সব কর্ম থেকে, যা তিনি একজন পিতা হিসেবে আমাদের দিয়ে করিয়েছেন, বলেছিলেন করতে, তা থেকে। তারই ছোট অনেক ঘটনা রয়েছে। ঘটনাগুলো বিচার করলে এর প্রভাব আমাদের জীবনে অনেক।

১৯৭৬ সালের কথা। তখন স্কুলে পড়ি। প্রতিদিনের মতো সেদিনও দুই ভাই স্কুলে যাচ্ছি। সকাল ৭টায় সেদিন আমরাও বের হচ্ছি। বাবা অফিসে যাচ্ছেন। গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। বাবা তার গাড়িতে উঠলেন। তার গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ তার গাড়ির ব্রেক লাইট জ্বলে উঠল। বাসার গেট থেকে বেরোবার আগেই জোর গলায় আমাদের গাড়ির ড্রাইভারকে ডাক দিলেন। সে দৌড়ে গেল। আমরা গাড়িতে বসেছিলাম, ড্রাইভার যখন ফিরে এলো, চেহারা দেখে মনে হলো বাঘের খাঁচা থেকে বের হয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম কী ব্যাপার? উত্তরে বলল, ‘স্যার বলেছেন আপনাদের এই বেলা নামিয়ে দিয়ে অফিসে গিয়ে পিএসের কাছে রিপোর্ট করতে। এখন থেকে ছোট গাড়ি নিয়ে স্কুলে যাওয়া-আসা করতে হবে। কারণ, ছোট গাড়িতে তেল কম খরচ হয়। আর এই গাড়ির চাকা খুলে রেখে দিতে হবে। উল্লেখ্য, ওই গাড়িটি ছিল সরকারি দামি বড় গাড়ি।

আরেকটি ঘটনা। বয়স কম। স্কুলে পড়ি। কিন্তু গালাগাল রপ্ত করেছি। সময় সুযোগ পেলে আক্রমণের সুযোগ হাতছাড়া করি না। সেদিনও করিনি। কারণটি পুরোপুরি মনে নেই। তবে বাসার বাইরের গেটের সামনে সন্ধ্যাবেলা পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে দুষ্টুমি করছি। রাস্তা দিয়ে মাঝেমধ্যেই গাড়ি যাওয়া-আসা করছে, গেটে কর্তব্যরত সেনাবাহিনীর গার্ড দাঁড়িয়ে ডিউটিতে। আমাকে বলল, ‘ভাইয়া সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ভেতরে যান।’ আর যায় কোথায়? খেলার মধ্যে বিড়ম্বনা, যা এলো মুখে স্বরচিত কবিতার মতো বলে গেলাম। খেলা শেষ। ভেতরে এলাম। ক্লান্ত। কোনোমতে পড়া শেষ করে রাতে খেয়ে ঘুম। ঘুমিয়ে ছিলাম বোধহয় ঘণ্টা দেড়েক। হঠাৎ মনে হলো ভূমিকম্প হচ্ছে।

চোখ খুলে দেখি শিকারের সময় বাঘ থাবা দিয়ে যেভাবে হরিণ শাবক ধরে, বাবা ঠিক সেভাবে হাত দিয়ে আমার মাথার চুল ধরে টেনে তুললেন এবং বাঘের মতো গর্জন করে বললেন, ‘কেন গাল দিয়েছিস? ও কি তোর বাপের চাকরি করে? যা মাফ চেয়ে আয়। মাকে বললেন, ‘যাও ওকে নিয়ে যাও। ও মাফ চাইবে তারপর ঘরে ঢুকবে।’ মা আমাকে নিয়ে গেলেন সামনের বারান্দায়। বিনা দোষে গাল খাওয়া ব্যক্তিটিকে ডেকে আনা হলো। যদিও লোকটি অত্যন্ত ভদ্রতার সঙ্গে মাকে বলল, ‘না ম্যাডাম, ভাইয়ার কথায় আমি কিছু মনে করিনি। ছোট মানুষ। ওমন করেই।’ জানি না তিনি আজ কোথায়। তবে ২৫ বছর পর আজ যদি বেঁচে থাকেন এবং এই লেখা পড়েন তবে বলছি, সেদিন না বুঝে যা বলেছি, তার জন্য আমি আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।

অনেক ঘটনার মধ্যে আরেকটি ঘটনা। তখন বাবা প্রেসিডেন্ট। হঠাৎ বিটিভি থেকে খবর এলো, গেলাম। তারা বললেন, গান গাইতে হবে। বয়স কম। গানের ‘গ’ও পারি না। তা-ও আবার টিভিতে। আমাকে পায় কে। প্রযোজক বললেন, কিচ্ছু না। আমি ঠিকই গান গাইয়ে নেব প্রেসিডেন্টের ছেলেকে দিয়ে এবং সুন্দর গান হবে। বুঝতেই পারছেন সবাই, কী গান গাইলাম। পরে যখন নিজে দেখলাম ও শুনলাম, মনে হলো সেই মুহূর্তে টিভি স্টেশনের কারেন্ট চলে গেলে ভালো হতো। যদিও রাতে স্বপ্ন দেখলাম বিরাট গায়ক হয়ে গেছি। কদিন পর প্রযোজককে ফোন করলাম, ‘চাচা, আবার কবে গান গাইব?’ উনি বললেন, ‘বাবা, প্রেসিডেন্টের পিএ ফোন করে তোমাকে টিভিতে অনুষ্ঠান দিতে বারণ করেছেন। বেশ গায়ক হবার খায়েশ মিটে গেল। আরেকটি ঘটনা লিখে শেষ করতে চাই। সব স্মরণীয় ঘটনা এই স্বল্প পরিসরে লেখা সম্ভব নয়।

১৯৮০ সালের ঘটনা। আব্বা শহীদ হওয়ার বছর খানেক আগের কথা। একদিন সন্ধ্যাবেলা দুই ভাই পরামর্শ করে বড় হিসেবে আমি গিয়ে দাঁড়ালাম আম্মার সামনে। বললাম, ‘আম্মু, আমরাও যাব তোমাদের সাথে।’ উনি বললেন, ‘কোথায়?’ আমি বললাম, ‘কেন, নেপাল।’ কারণ, এর কয়েকদিন আগে নেপালের রাজা বীরেন্দ্র তার রানী এবং দুই ছেলে বাংলাদেশ সফরে আসেন। ফিরতি সফরে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আব্বা আম্মাকে নিয়ে দুদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে নেপাল যাচ্ছিলেন। তাই আমরাও ভাবলাম, রাজার ছেলে যদি আসতে পারে, তবে আমরাও যেতে পারি। সমস্যা কোথায়? আম্মা আমার উত্তর শুনে মুচকি হাসলেন। এদিকে আব্বা কোন সময়ে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন, খেয়াল করিনি। হঠাৎ পেছন থেকে ভারি গলার আওয়াজ এলো। কিন্তু তাতে ছিল স্নেহের পরশ। আব্বু বললেন, ‘তা ঠিক, রাজার ছেলেরা এসেছিল বাংলাদেশে। কারণ তারা রাজার ছেলে। কিন্তু তোমরা যদি সঙ্গে যাও, মানুষ আমাকে মন্দ বলবে। তুমি কি তাই চাও?’ প্রথমে খুব ভয়ে ভয়ে কথাগুলো শুনলাম। পরে বুঝলাম, আব্বা কী বোঝাতে চাচ্ছেন। যদিও দুই ভাই একটু মন খারাপ করলাম। তবে তা ছিল সাময়িক।

উল্লিখিত ঘটনাগুলো বহু ঘটনার মধ্যেই সামান্য কয়েকটি মাত্র, পড়লে মনে হবে আর সব ঘটনার মতো স্বাভাবিক। কিন্তু এই ঘটনা থেকে আমরা দুই ভাই যা শিখেছি, তার কিছু ব্যাখ্যার হয়তো প্রয়োজন আছে। আজ যারা বয়সে আমার চেয়ে ছোট, তাদের জন্য এমনটি ক্ষেত্রবিশেষে অনেক কিছু শেখার আছে। যেমন প্রথম গাড়ির যে ঘটনাটি লিখেছি, তা থেকে যা শিখেছি, তা হলো জীবনে যতটুকু সম্ভব অপচয় না করা এবং একই সঙ্গে অহেতুক বিলাসিতা না করা। শুধু তাই নয়, নিজের যোগ্যতা অর্জন করে তারপরই কোনোকিছু ভোগ করা ঠিক। একইভাবে দ্বিতীয় ঘটনা থেকে একজন মানুষের এটাই শিক্ষা নেওয়া উচিত, কোনো সামাজিক অবস্থান থেকেই আরেকজন মানুষকে কোনো কটু কথা বলা অথবা খারাপ ব্যবহার করা উচিত নয়। প্রত্যেকেরই উচিত প্রত্যেকের তার প্রাপ্য সম্মান প্রদান করা, যা জীবনের একটি মূল্যবান শিক্ষা। মানুষের জীবনে চলার পথে বহু ঘটনা এবং কমবেশি প্রতিটি ঘটনা থেকেই মানুষ শিক্ষা নিতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র দেশে যেখানে আমাদের মতো লোক যারা কিছুটা হলেও ভালো থাকি, সামাজিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করি, তাদের উচিত সুযোগ বা সুবিধা থাকলে তা ব্যবহার করতে হবে এই মানসিকতা ত্যাগ করা। তাতে হারানোর কিছুই নেই। বরং পাওয়া যায় মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ আমাদের দুই ভাইয়ের বাবা।

লেখক: বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র

বি. দ্র. লেখাটি পুনর্মুদ্রিত

সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

আপডেটের সময় : ০৯:১৭:২৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৩০ মে ২০২৫
৫৫২ Time View

আমার শিক্ষক

আপডেটের সময় : ০৯:১৭:২৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৩০ মে ২০২৫

৩০ মে। আমাদের পরিবারের জন্য দিনটি সবচেয়ে বেদনাদায়ক। এই দিনে বাংলাদেশের বহু মানুষ যেমন তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে হারিয়েছিল, তেমনি আমরা দুই ভাই হয়েছিলাম এতিম। একুশ বছর আগে এই দিনের কথা দীর্ঘ সময় ধরে যতবারই মনে হয়েছে, ততবারই শোকে বেদনায় ভারি হয়েছে হৃদয়। আজ আমিও এক সন্তানের জনক। কিন্তু এই দিনটি ক্যালেন্ডারের পাতায় ঘুরে এলে ফিরে যাই একুশ বছর আগের সেই দিনে। নিজেকে এতিম, অসহায় সেই কিশোরই মনে হয়। জীবনের স্মৃতি আবছা হয়ে গেছে। একমাত্র এই দিনের স্মৃতি মনের মধ্যে আছে পরিষ্কার স্পষ্ট। আমার বিশ্বাস, আমি, আমার ভাই এবং আরও যারা আছেন আমাদের মতো পিতৃহারা, একমাত্র তারাই এই ব্যথা অনুভব করতে পারবেন। ১৯৮১ সালের পর ৩০ মে বহুবার এসেছে জীবনে। যতদিন বেঁচে থাকব, ঘুরে ঘুরে প্রতি বছর দিনটি আসবে। কিন্তু আমরা তো কখনো ১৯৮১ সালের ২৯ মে’তে ফিরে যেতে পারব না। ৩০ মে’র পর যখন দেখলাম লাখ লাখ মানুষ চোখের পানি নিয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে একটি কফিনের পেছনে দাঁড়িয়ে তাদের নেতাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন, তখন শুধু এটুকুই মনে হয়েছিল, একটি মানুষ কীভাবে এত লাখো কোটি মানুষ আপন করে নিতে পারেন, কেমন করে পারেন কোটি মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিতে। সেই লাখো কোটি মানুষের প্রিয় জিয়াউর রহমানের সন্তান আমি, এটি মনে হলে বাবাকে হারানোর ব্যথা একটু হলেও লাঘব হয়। যখন মনে পড়ে, লাখ লাখ লোক জানাজায় এবং রেডিও টিভির সামনে বসে কোটি কোটি মানুষ আল্লাহর দরবারে তাদের প্রিয় মানুষটির জন্য দোয়া করছেন, তখন পিতার মৃত্যুর বেদনা অল্প হলেও প্রশমিত হয়। আজও মনে পড়ে জানাজার দিনের সেই অচেনা মুরুব্বির কথা, তিনি বলেছিলেন, ‘বাবা, কাঁদতে নেই; দেখ লাখ লাখ মানুষ এসেছে এই জানাজায়। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমার বাবাকে বেহেশত নসিব করবেন; তোমরা কাঁদলে তোমার বাবার আত্মা কষ্ট পাবে।’ আজও যখন বাদ জুমা বাবার কবর জিয়ারতে যাই, একজন মানুষ হলেও পাই সেখানে সেই সময়ে, যে তার নেতার জন্য দুহাত তুলে দোয়া করছে। যাকে আগে কোনোদিন দেখিনি; হয়তো আর কোনোদিন দেখবও না। আসলে এত মানুষের দোয়ার জন্য আজও মাঝে মাঝে মনে হয় বাবা আমাদের মধ্যেই আছেন, হয়তো অফিসে গেছেন, কাজ শেষ হলেই চলে আসবেন। যেমন মনে হয়েছিল ২৯ মে ১৯৮১ সালে। আমার বাবা যখন মারা যান, তখন আমার বয়স ১৪-১৫ বছর। অর্থাৎ যে সময় একজন কিশোরের জীবনের পথ চলতে শেখার জন্য দরকার তার জীবনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য শিক্ষককে, অর্থাৎ তার বাবাকে। কিন্তু আমার এবং ভাইয়ের কারও এই শিক্ষকের কাছ থেকে সরাসরি বেশি কিছু শেখার অবকাশ হয়নি। তার প্রধান কারণ, আমাদের এই শিক্ষকের কাঁধে ন্যস্ত ছিল সেই সময়ে সমগ্র দেশ ও জনগণের গুরুদায়িত্ব। তাই জীবনের পরবর্তী সময়ে আমাদের শিখতে হয়েছে এই শিক্ষকের রেখে যাওয়া সততা থেকে, শিখতে হয়েছে তার রেখে যাওয়া আদর্শ থেকে এবং সেই সব কর্ম থেকে, যা তিনি একজন পিতা হিসেবে আমাদের দিয়ে করিয়েছেন, বলেছিলেন করতে, তা থেকে। তারই ছোট অনেক ঘটনা রয়েছে। ঘটনাগুলো বিচার করলে এর প্রভাব আমাদের জীবনে অনেক।

১৯৭৬ সালের কথা। তখন স্কুলে পড়ি। প্রতিদিনের মতো সেদিনও দুই ভাই স্কুলে যাচ্ছি। সকাল ৭টায় সেদিন আমরাও বের হচ্ছি। বাবা অফিসে যাচ্ছেন। গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। বাবা তার গাড়িতে উঠলেন। তার গাড়ি বেরিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ তার গাড়ির ব্রেক লাইট জ্বলে উঠল। বাসার গেট থেকে বেরোবার আগেই জোর গলায় আমাদের গাড়ির ড্রাইভারকে ডাক দিলেন। সে দৌড়ে গেল। আমরা গাড়িতে বসেছিলাম, ড্রাইভার যখন ফিরে এলো, চেহারা দেখে মনে হলো বাঘের খাঁচা থেকে বের হয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম কী ব্যাপার? উত্তরে বলল, ‘স্যার বলেছেন আপনাদের এই বেলা নামিয়ে দিয়ে অফিসে গিয়ে পিএসের কাছে রিপোর্ট করতে। এখন থেকে ছোট গাড়ি নিয়ে স্কুলে যাওয়া-আসা করতে হবে। কারণ, ছোট গাড়িতে তেল কম খরচ হয়। আর এই গাড়ির চাকা খুলে রেখে দিতে হবে। উল্লেখ্য, ওই গাড়িটি ছিল সরকারি দামি বড় গাড়ি।

আরেকটি ঘটনা। বয়স কম। স্কুলে পড়ি। কিন্তু গালাগাল রপ্ত করেছি। সময় সুযোগ পেলে আক্রমণের সুযোগ হাতছাড়া করি না। সেদিনও করিনি। কারণটি পুরোপুরি মনে নেই। তবে বাসার বাইরের গেটের সামনে সন্ধ্যাবেলা পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে দুষ্টুমি করছি। রাস্তা দিয়ে মাঝেমধ্যেই গাড়ি যাওয়া-আসা করছে, গেটে কর্তব্যরত সেনাবাহিনীর গার্ড দাঁড়িয়ে ডিউটিতে। আমাকে বলল, ‘ভাইয়া সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ভেতরে যান।’ আর যায় কোথায়? খেলার মধ্যে বিড়ম্বনা, যা এলো মুখে স্বরচিত কবিতার মতো বলে গেলাম। খেলা শেষ। ভেতরে এলাম। ক্লান্ত। কোনোমতে পড়া শেষ করে রাতে খেয়ে ঘুম। ঘুমিয়ে ছিলাম বোধহয় ঘণ্টা দেড়েক। হঠাৎ মনে হলো ভূমিকম্প হচ্ছে।

চোখ খুলে দেখি শিকারের সময় বাঘ থাবা দিয়ে যেভাবে হরিণ শাবক ধরে, বাবা ঠিক সেভাবে হাত দিয়ে আমার মাথার চুল ধরে টেনে তুললেন এবং বাঘের মতো গর্জন করে বললেন, ‘কেন গাল দিয়েছিস? ও কি তোর বাপের চাকরি করে? যা মাফ চেয়ে আয়। মাকে বললেন, ‘যাও ওকে নিয়ে যাও। ও মাফ চাইবে তারপর ঘরে ঢুকবে।’ মা আমাকে নিয়ে গেলেন সামনের বারান্দায়। বিনা দোষে গাল খাওয়া ব্যক্তিটিকে ডেকে আনা হলো। যদিও লোকটি অত্যন্ত ভদ্রতার সঙ্গে মাকে বলল, ‘না ম্যাডাম, ভাইয়ার কথায় আমি কিছু মনে করিনি। ছোট মানুষ। ওমন করেই।’ জানি না তিনি আজ কোথায়। তবে ২৫ বছর পর আজ যদি বেঁচে থাকেন এবং এই লেখা পড়েন তবে বলছি, সেদিন না বুঝে যা বলেছি, তার জন্য আমি আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।

অনেক ঘটনার মধ্যে আরেকটি ঘটনা। তখন বাবা প্রেসিডেন্ট। হঠাৎ বিটিভি থেকে খবর এলো, গেলাম। তারা বললেন, গান গাইতে হবে। বয়স কম। গানের ‘গ’ও পারি না। তা-ও আবার টিভিতে। আমাকে পায় কে। প্রযোজক বললেন, কিচ্ছু না। আমি ঠিকই গান গাইয়ে নেব প্রেসিডেন্টের ছেলেকে দিয়ে এবং সুন্দর গান হবে। বুঝতেই পারছেন সবাই, কী গান গাইলাম। পরে যখন নিজে দেখলাম ও শুনলাম, মনে হলো সেই মুহূর্তে টিভি স্টেশনের কারেন্ট চলে গেলে ভালো হতো। যদিও রাতে স্বপ্ন দেখলাম বিরাট গায়ক হয়ে গেছি। কদিন পর প্রযোজককে ফোন করলাম, ‘চাচা, আবার কবে গান গাইব?’ উনি বললেন, ‘বাবা, প্রেসিডেন্টের পিএ ফোন করে তোমাকে টিভিতে অনুষ্ঠান দিতে বারণ করেছেন। বেশ গায়ক হবার খায়েশ মিটে গেল। আরেকটি ঘটনা লিখে শেষ করতে চাই। সব স্মরণীয় ঘটনা এই স্বল্প পরিসরে লেখা সম্ভব নয়।

১৯৮০ সালের ঘটনা। আব্বা শহীদ হওয়ার বছর খানেক আগের কথা। একদিন সন্ধ্যাবেলা দুই ভাই পরামর্শ করে বড় হিসেবে আমি গিয়ে দাঁড়ালাম আম্মার সামনে। বললাম, ‘আম্মু, আমরাও যাব তোমাদের সাথে।’ উনি বললেন, ‘কোথায়?’ আমি বললাম, ‘কেন, নেপাল।’ কারণ, এর কয়েকদিন আগে নেপালের রাজা বীরেন্দ্র তার রানী এবং দুই ছেলে বাংলাদেশ সফরে আসেন। ফিরতি সফরে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আব্বা আম্মাকে নিয়ে দুদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে নেপাল যাচ্ছিলেন। তাই আমরাও ভাবলাম, রাজার ছেলে যদি আসতে পারে, তবে আমরাও যেতে পারি। সমস্যা কোথায়? আম্মা আমার উত্তর শুনে মুচকি হাসলেন। এদিকে আব্বা কোন সময়ে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন, খেয়াল করিনি। হঠাৎ পেছন থেকে ভারি গলার আওয়াজ এলো। কিন্তু তাতে ছিল স্নেহের পরশ। আব্বু বললেন, ‘তা ঠিক, রাজার ছেলেরা এসেছিল বাংলাদেশে। কারণ তারা রাজার ছেলে। কিন্তু তোমরা যদি সঙ্গে যাও, মানুষ আমাকে মন্দ বলবে। তুমি কি তাই চাও?’ প্রথমে খুব ভয়ে ভয়ে কথাগুলো শুনলাম। পরে বুঝলাম, আব্বা কী বোঝাতে চাচ্ছেন। যদিও দুই ভাই একটু মন খারাপ করলাম। তবে তা ছিল সাময়িক।

উল্লিখিত ঘটনাগুলো বহু ঘটনার মধ্যেই সামান্য কয়েকটি মাত্র, পড়লে মনে হবে আর সব ঘটনার মতো স্বাভাবিক। কিন্তু এই ঘটনা থেকে আমরা দুই ভাই যা শিখেছি, তার কিছু ব্যাখ্যার হয়তো প্রয়োজন আছে। আজ যারা বয়সে আমার চেয়ে ছোট, তাদের জন্য এমনটি ক্ষেত্রবিশেষে অনেক কিছু শেখার আছে। যেমন প্রথম গাড়ির যে ঘটনাটি লিখেছি, তা থেকে যা শিখেছি, তা হলো জীবনে যতটুকু সম্ভব অপচয় না করা এবং একই সঙ্গে অহেতুক বিলাসিতা না করা। শুধু তাই নয়, নিজের যোগ্যতা অর্জন করে তারপরই কোনোকিছু ভোগ করা ঠিক। একইভাবে দ্বিতীয় ঘটনা থেকে একজন মানুষের এটাই শিক্ষা নেওয়া উচিত, কোনো সামাজিক অবস্থান থেকেই আরেকজন মানুষকে কোনো কটু কথা বলা অথবা খারাপ ব্যবহার করা উচিত নয়। প্রত্যেকেরই উচিত প্রত্যেকের তার প্রাপ্য সম্মান প্রদান করা, যা জীবনের একটি মূল্যবান শিক্ষা। মানুষের জীবনে চলার পথে বহু ঘটনা এবং কমবেশি প্রতিটি ঘটনা থেকেই মানুষ শিক্ষা নিতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো একটি দরিদ্র দেশে যেখানে আমাদের মতো লোক যারা কিছুটা হলেও ভালো থাকি, সামাজিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করি, তাদের উচিত সুযোগ বা সুবিধা থাকলে তা ব্যবহার করতে হবে এই মানসিকতা ত্যাগ করা। তাতে হারানোর কিছুই নেই। বরং পাওয়া যায় মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ আমাদের দুই ভাইয়ের বাবা।

লেখক: বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জ্যেষ্ঠ পুত্র

বি. দ্র. লেখাটি পুনর্মুদ্রিত