Wednesday , 8 May 2024
শিরোনাম

নারীমুক্তির পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া

সারাবান তহুরা:

‘…আমরা লেডি কেরানি হইতে আরম্ভ করিয়া লেডি ম্যাজিস্ট্রেট, লেডি ব্যারিস্টার, লেডি জজ সবই হইব’—সার্ধশত বছর আগে স্বপ্নদ্রষ্টা বেগম রোকেয়া অবরোধবাসিনী নারীর শুধু অবরোধ মোচন করার স্বপ্ন দেখেই ক্ষান্ত হননি। অন্যায়, অত্যাচার, অবহেলা আর অশিক্ষায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত হাজার বছরের দুর্ভাগ্যপীড়িত নারীকে শিক্ষায়, শৌর্যে, মর্যাদায় সমাজে উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখেছেন।

যে মেয়েটি গভীর রাতে পরিবারের সবাই ঘুমিয়ে পড়লে মোমের মৃদু আলোয় বড় ভাইয়ের কাছে চুপিসারে বিদ্যা অর্জনে ব্রতী হয়েছিলেন তিনি কি ভেবেছিলেন একদিন ভারতীয় নারীর ভাগ্যাকাশের অন্ধকার দূরীভূত করে তাঁদের জন্য স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনতে তিনি জীবন উৎসর্গ করবেন? ‘ভগিনীরা ওঠো, জাগো, চক্ষু রগড়াইয়া চাহিয়া দেখো পুব আকাশে সূর্য উঠিতেছে’—নারীর প্রতি এই আহ্বান তাঁর জীবনের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান-স্বপ্ন, যা বাস্তবায়নের জন্য তিনি লেখনী ধারণ করেছেন, স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। পশ্চাৎপদ সমাজের প্রচলিত কূপমণ্ডূকতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে আজীবন লড়াই করেছেন।

বড় বোন করিমুন্নেসার কাছে হাতেখড়ি হওয়ার পর ভাই ইব্রাহিম সাবের ইংরেজি, বাংলা, অঙ্ক শিখিয়ে তাঁর শিক্ষার দ্বার খুলে দিয়েছিলেন। ১৪ বছর বয়সে বিপত্নীক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিয়ের পর উদারমনস্ক স্বামীর সাহচর্যে তাঁর অধ্যয়ন ও সাহিত্যচর্চা চলতে থাকে। ইংল্যান্ডফেরত স্বামীর সান্নিধ্যে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা পঠন-পাঠনের সুবর্ণ সুযোগ লাভ করেন জ্ঞানপিপাসু বেগম রোকেয়া। তিনি মানসিকভাবে সমৃদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন।

পদে পদে নারীর দুর্বহ বেদনা জর্জর জীবনের অব্যক্ত করুণ কান্না বেগম রোকেয়া উপলব্ধি করেছেন। জীবনের প্রথম লগ্নে কৈশোরে পিতৃগৃহে—‘অবিবাহিত বালিকাগণ স্ত্রীলোকের সহিতও পর্দা করিতে বাধ্য থাকেন। কখন কোন প্রতিবেশী আসিয়া উপস্থিত হইবে এই ভয়ে নবম বর্ষীয়া বালিকা প্রাঙ্গণের বাহির হয় না। ’ এভাবে সর্বদা ধর্মের সীমা ছাড়িয়ে পর্দাপ্রথার সামাজিক ভয়াবহতা রোকেয়া নিজের জীবনে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন। তিনি দেখেছেন, শৈশবেই নারীর শিক্ষা ও সত্তা বিকাশের মানসিক ও বাহ্যিক প্রতিবেশ পুরুষতন্ত্র পর্দার মাধ্যমে ধ্বংস করে দেয়। রোকেয়া জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছেন, ‘শিক্ষার অভাবে আমরা অনুপযুক্ত হইয়াছি। অযোগ্য হইয়াছি বলিয়া স্বাধীনতা হারাইয়াছি। অদূরদর্শী পুরুষেরা ক্ষুদ্র স্বার্থ রক্ষার জন্য এতদিন আমাদিগকে শিক্ষা হইতে বঞ্চিত করিয়াছেন। ’

নারীর ওপর সামাজিক ভণ্ডামি আর অমানবিক সমাজব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়ে মেয়েশিশুদের অসহনীয় নিয়মের জালে জড়িয়ে এমন কঠিন বেড়াজালে অন্ধকারে আটকে রেখে বড় করা হতো যেন বাইরের মুক্ত আলো-বাতাস তার দেহমনকে স্পর্শ করতে না পারে। নারীকে গড়ে তোলা হতো শুধু স্বামীর সংসারে মানিয়ে নেওয়ার জন্য সহবত শিক্ষা দেওয়ার নামে তাঁর স্বাভাবিক বুদ্ধির বিকাশের কোনো শিক্ষা নয়, সুযোগ নয়, অঙ্কুরেই তাঁর সৃজনশীল অনুসন্ধিত্সু মনের ওপর নানা প্রথার বোঝা চাপিয়ে একটি জড়ভরত নারী পুতুল তৈরি করার সব ধরনের আয়োজন চলতে থাকত। তাঁর বোধবুদ্ধি জাগ্রত হওয়ার কোনো অবকাশ তো ছিলই না, তার ওপর জগত্সংসার সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হওয়ার আগেই, পুতুল খেলার পর্ব শেষ না হতেই বিয়ে বিয়ে খেলার মধ্য দিয়ে তাঁকে দ্বিতীয় কারাগারে নিক্ষেপ করা হতো। এ যেন বন্দিদশার দ্বিতীয় পর্ব, চরম অবমাননাকর জীবনের আরেক অধ্যায়ের সূত্রপাত। বিয়ের মাধ্যমে যেন নারীর জীবিকা উপার্জনের একমাত্র উপায় চাকরি। নারীর আর কোনো উপায়ে উপার্জন হতে পারে না। সেই চেষ্টা করার কোনো সুযোগ সমাজ তাঁর সামনে খোলা রাখেনি।

বেগম রোকেয়া সমাজ থেকে এগিয়ে ছিলেন চিন্তায়, চেতনায়, মননে। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন নারী শিক্ষার দ্বারা তাঁর জীবনের অন্ধকার দূরীভূত করার জন্য শিক্ষার আলো জ্বালানোর কোনো বিকল্প নেই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অচলায়তন ভেঙে নারীর স্বাধীন মুক্ত জীবনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথরেখা তৈরি করার ব্রত নিয়ে বেগম রোকেয়া প্রতিষ্ঠা করলেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। প্রথমে ভাগলপুরে, পরে কলকাতায়। ছাত্রীসংখ্যা ছিল আট। গাড়ির চারপাশে পর্দা দিয়ে ঘিরে ছাত্রীদের স্কুলে আনা-নেওয়ার ব্যবস্থা করলেন।

সমাজের রক্তচক্ষু তাঁর দিকে সব সময় শত শত প্রতিবন্ধকতার বেড়াজাল তুলে দিলেও তিনি পিছপা হননি। তিনি জানতেন যে শতাব্দীর জমাট অন্ধকার দুই হাতে সরিয়ে সরিয়ে তাঁকে সামনের পথ কেটে কেটে এগিয়ে যেতে হবে। নারীসমাজের মুক্তির পথ অন্বেষণের যে বন্ধুর পথে তিনি পা বাড়িয়েছিলেন তা যে কুসুমাস্তীর্ণ হবে না তা তাঁর চেয়ে আর কে বেশি জানবে! একদিকে তিনি নারীশিক্ষা বিস্তারের জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন, অন্যদিকে ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে সমাজ মানস বদলে সচেষ্ট হয়েছেন। সেই সঙ্গে নারীর শিক্ষার পাশাপাশি সমাজে মর্যাদাপূর্ণ আসন তৈরির জন্য আন্দোলন গড়ে তুলেছেন।

শুধু নারীশিক্ষা নয়, সমগ্র ভারতবর্ষের শিক্ষানীতি নিয়েও তিনি সারগর্ভ বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁর ‘Education Ideas for Modern Indian Girls’ বিষয়ক নিবন্ধে তিনি ভারতের প্রাচীনকালের গুরুগৃহের শিক্ষা থেকে শুরু করে ওই সময়কালের আবাসিক শিক্ষাঙ্গনসহ শিক্ষাবিষয়ক দীর্ঘ আলোচনায় সুচিন্তিত বাস্তবমুখী মতামত ব্যক্ত করেছেন। তাঁর দূরদৃষ্টিতে ভারত রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনাও প্রতিফলিত হয়েছে। অগ্রসর চিন্তার অধিকারী রোকেয়া ভারতীয় উপমহাদেশের ভবিষ্যৎ ও শিক্ষা নিয়ে যে মতামত ব্যক্ত করেছেন এ পর্যায়ে তাঁকে একজন ভবিষ্যত্দ্রষ্টা ও দার্শনিক হিসেবে আমরা দেখতে পাই। সেই সঙ্গে আরো একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, বেগম রোকেয়া ভারতীয় উপমহাদেশে নারীসমাজের ভোটাধিকার আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে ভারতীয় নারীর ভোটাধিকার অর্জনের আন্দোলন সফল হয়। ভোটাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে বেগম রোকেয়ার সম্পৃক্তি এবং তারই যোগসূত্র হিসেবে বেঙ্গল উইমেন্স এডুকেশন লীগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন।

স্বল্প পরিসরে রোকেয়ার কর্মময় জীবন আলোকপাত করা সম্ভব নয়। এককথায় বলা যায়, এই মহীয়সী নারী তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছেন মানুষের কল্যাণে। ‘বুক ঠুকিয়া বল নারী আমরাও মানুষ’—নারীর মানুষ হয়ে ওঠার এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে ব্যাপৃত এ মহীয়সী নারীর জীবনের ওপর আরো গভীরভাবে আলোকপাত করা প্রয়োজন।

লেখক : প্রকাশনা সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ

Check Also

১৩৯ উপজেলায় আজ ভোট, ইসির যত প্রস্তুতি

ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে ১৩৯ উপজেলায় ভোট গ্রহণ বুধবার (৮ মে) অনুষ্ঠিত হবে। …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

x