Thursday , 9 May 2024
শিরোনাম

পাট গাছ- বাংলাদেশের সোনালী আঁশ

সুজলা-সুফলা-শষ্য-শ্যামলা আমাদের এই বাংলাদেশের উর্বর মাটি বিভিন্ন উদ্ভিদ জন্মানোর জন্য খুবই ভাল। বাংলাদেশের আনাচে কানাচে প্রচুর উদ্ভিদ জন্মায় যা আমাদের জন্য খুবই উপকারী। পাট গাছ এমনই এক উদ্ভিদ।
যে গাছ দেশের গন্ডি পেরিয়ে সম্পূর্ণ বিশ্বেও ব্যপক সমাদৃত। আজ আমরা বিস্তারিত জানবো এই বাংলাদেশের সোনালী আঁশ পাট সম্পর্কে। youtube music crack
নামকরণ:
ধারণা করা হয় সংস্কৃত পট্ট শব্দ থেকে পাট শব্দটির উদ্ভব হয়েছে। পাটের ইংরেজি হাচ্ছে জুট (Jute )। সম্ভবত উড়ে বা ভারতীয় উড়িষ্যা ভাষা থেকে এসেছে।
আমাদের দেশের চট্টগ্রামে কচি বা ছোট পাটকে শাক হিসেবে খাওয়া হয়। এবং একে “নারিস” শাক নামে অভিহিত করা হয়।
বৈজ্ঞানিক নাম:
পাট গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Corchorus spp.
দেশী সাদা পাট গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Corchorus capsularis ও তোষা পাট গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Corchorus olitorius.
পরিবার:
পাট গাছ Tiliaceae পরিবারের অন্তর্গত একটি উদ্ভিদ।
প্রাপ্তিস্থান:
সাধারণত নিচু ভূমি এবং জলাযুক্ত এলাকায় পাট ভাল জন্মায়। তবে জলাবদ্ধতায় নয়।
বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায় পাট গাছ জন্মায়। সবচেয়ে বেশি ফলে ফরিদপুর, টাঙ্গাইল, যশোর, ঢাকা, শিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও জামালপুরে।
ফরিদপুরকে পাট উৎপাদনের রাজধানী বলা হয়।
প্রজাতি:
দেশে ৪ প্রজাতির পাট জন্মায়।
১. কেনাফ পাট গাছ
২. মেস্তা পাট গাছ
৩. দেশী পাট গাছ
৪. তোষা পাট গাছ
কেনাফ ও মেস্তা পাট গাছের ফলন হয় কম পরিমাণে। আর দেশী ও তোষা পাট গাছ জন্মায় বেশি পরিমাণে।
আকার-আকৃতি:
পাটের লিকলিকে এক কান্ডবিশিষ্ট শরীর দ্রুত বর্ধনশীল। লম্বা হয় সর্বোচ্চ ১৪ ফুট পর্যন্ত।
পাটের পাতা ১৫-২০ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়।
গঠন ও বৈশিষ্ট্য: download key pes 2017
পাট একটি তন্তু জাতীয় দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদ। একক কান্ড বিশিষ্ট এই গাছের সর্বাঙ্গই সবুজ।
পাট গাছের কান্ডটি খুবই সরু। এই কান্ডের বাকল থেকে মূলত পাটের আঁশ পাওয়া যায়।
পাতাগুলো লম্বা-চওড়ায় বড়, ঘন সবুজ, মসৃণ এবং চকচকে।
পাটগাছে বীজ জন্মায়। যা থেকে পরবর্তীতে পাট চাষ করা সম্ভব। চাষীরা এর সঠিক প্রকৃয়াজাতকরণের মাধ্যমে আবার ফসল ফলায়।
আয়ুষ্কাল:
পাট একটি বর্ষজীবী উদ্ভিদ। এর আয়ুষ্কাল ১০০ থেকে ১২০ দিন পর্যন্ত।
পাটের আঁশ:
পাটের আঁশ প্রধানত সেলুলোজ এবং লিগনিন দ্বারা গঠিত। সাধারণত পাট গাছ জৈব প্রক্রিয়ায় পানিতে জাগ দেওয়ার মাধ্যমে এর আঁশ ছাড়ানো হয়।
পাটের আঁশ নরম, উজ্জ্বল এবং চকচকে। আঁশগুলো ১-৪ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়।
একক আঁশ ১৭-২০ মাইক্রন পর্যন্ত মোটা হয়ে থাকে।
তোষা, দেশী, কেনাফ ও মেস্তা এই ৪ জাতের পাট গাছের মধ্যে তোষা পাট গাছের আঁশ সবচেয়ে সূক্ষ্ম, মসৃণ ও শক্ত।
পাট চাষ:
পাটের আবাদ শুরু হয় চৈত্র-বৈশাখ মাসের প্রাক বর্ষায়। বৃষ্টির পানি বেশিক্ষণ থাকে না এমন দোঁয়াশ মাটি পাট চাষের জন্য বেশি উপযোগী।
পাট গাছ পুরোপুরি বর্ষাকালীন ফসল। ভাল ফলনের জন্য মাসে কমপক্ষে ২৫০ মিলিমিটার বৃষ্টির প্রয়োজন হয়।
পাট ভাল ভাবে বেড়ে ওঠতে বেশি সারেরও প্রয়োজন হয় না। শুধুমাত্র ইউরিয়া সার দিলেই চলে।
তাই তুলনামূলক কম খরচেই প্রচুর ফসল ফলানো সম্ভব।
পাট থেকে আঁশ বের করার পদ্ধতি:
পাট গাছের আঁশ মূলত সেলুলোজ এবং লিগনিন দ্বারা গঠিত। সাধারণত পাট গাছকে জৈব প্রক্রিয়ায় পানিতে জাগ দেয়ার মাধ্যমে আঁশ জোগাড় করা হয়।
চাষীরা পাট গাছ কাটতে শুরু করে রোপনের ৪-৫ মাসের মাথায়। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের ভরা বর্ষায়।
কাটার পর আঁটিবাধা পাট গাছ সাধারণত জাগ দেওয়া হয় ধারেকাছের জলাশয়ে।

জাগ দেওয়া পাট গাছ
জাগ দেওয়া পাট গাছ
আড়াআড়ি এবং লম্বালম্বি ভাবে রাখা আঁটির স্তুপ চাষীরা জালমগ্ন করে এমন ভাবে যেন জাগের মধ্যে পানি এবং পাট পঁচানোর ব্যাকটেরিয়া সহজেই যাতায়াত করতে পারে।
সাধারণত ২-৩ সপ্তাহ পানিতে ভিজলে পঁচে যায় গাছের বাকল। এরপরের কাজ হচ্ছে বাকলগুলো আলাদা করা।
গাছের কান্ড থেকে পঁচে যাওয়া বাকল আলাদা করার পর অল্প স্রোতের স্বচ্ছ জলে ভাল করে ধুলে বেরিয়ে আসে কাঙ্খিত আঁশ।
বর্তমান প্রযুক্তির কারণে জলাশয়ে জাগ দেওয়ার বদলে রিবন রেটিং পদ্ধতিতেও পাটের আঁশ বা বাকল পাট গাছ থেকে আলাদা করা হয়।
জাগ দেওয়ার কায়দা, পঁচনের মাত্রা এবং আঁশ ধোওয়ার পানির গুণগত মান ঠিক থাকলে প্রাপ্ত আঁশেরও রঙ এবং মান ঠিকঠাক থাকে।
জলে ধোয়া এই পাট তন্তু শতভাগ জীবাণু বিয়োজ্য, পুনর্ব্যবহারযোগ্য এবং পরিবেশবান্ধব। রোদে শুকানোর পরই ফুটে বের হয় পাটের আসল রঙ ও উজ্জ্বলতা।
এবার পাটের আঁশগুলো রোদে শুকানোর পালা। সঠিকভাবে রোদে শুকানোর পরই পাওয়া যায় কাঙ্খিত পাটের আঁশ তন্তু।
এবার পাটের আঁশগুলোর গন্তব্য স্থানীয় বাজার কিংবা সরাসরি পাট ক্রয় কেন্দ্রে।
উষ্ণ-আদ্র জলবায়ু ও পলিময় মাটির কারণে পাট বাংলাদেশে বহুল পরিমাণে জন্মায়। বাংলাদেশের চাষীদের ফলানো এই পাট গুণে-মানে বিশ্বসেরা।
বাংলাদেশে ৮ লাখ হেক্টরেরও বেশি জমি জুড়ে বছরে উৎপাদিত হচ্ছে ১৭ লাখ টনেরও বেশি পাট।
পাটের উপকারিতা:
সেলুলোজ এবং লিগনিন দিয়ে গঠিত এই আঁশ বহুমুখী ব্যবহারযোগ্য। পাটের আঁশ ব্যবহার করে নানারকম পাটপণ্য তৈরি হয় দেশের ২২ টি সরকারি ও ১৯৭ টি বেসরকারি পাটকলে।
রংবাহারি পাট সুতার প্রধান রপ্তানিকারক হিসেবে পরিণত হওয়া বাংলাদেশে পাটের বহুমুখী পণ্য উৎপাদনে বিপ্লব এনেছে সরকারি জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার এবং বেসরকারি শিল্পোদ্যোক্তারা। তৈরি হয়েছে ২৪০ ধরনের আকর্ষনীয় পাটপণ্য।
অর্থনৈতিক গুরুত্ব: পাট বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ বিভন্নভাবে প্রচুর অর্থ আয় করে।
২০১৭ সালে দেশের ১.৮৭ লাখ হেক্টর জমির পাট বাজারে জোগান দিয়েছে প্রায় ৯২ লাখ বেল আঁশ। যা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের সর্বোচ্চ।
তুলার পর পাট বিশ্বের দ্বিতীয় লাভজনক আঁশ ফসল।
তাই বাংলাদেশের পাট ও পাটপণ্যের চাহিদা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে আয় হয়েছে ৯৬ কোটি মার্কিন ডলার।
৫০টি দেশে ১৫ লাখ ৩০ হাজার টন পাটপণ্য রপ্তানি করে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশের আয় হয়েছিল ৭৯ কেটি ডলার।
ব্যবহারিক গুরুত্ব:
কলকারখানার পাটের ভেজিটেবল ফাইবার টুকরো টুকরো করে কেটে নানা প্রকৃয়ার মাধ্যমে বানানো হয় পাল্প। এই পাল্প থেকে তৈরি করা হয় সুতা।

বহুমুখী পাটজাত পণ্য
বহুমুখী পাটজাত পণ্য
বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা এবং পরিবেশবান্ধব ভেজিটেবল ফাইবার দিয়ে বানানো এই সুতা সুতলি, দড়ি, চট, বস্তা সহ পাট পণ্য তৈরির মূল উপাদান। যা আমাদের নিত্য ব্যবহার্য্য জিনিস।
অন্যান্য কৃত্তিম ও প্রাকৃতিক আঁশের সঙ্গে মেশানো যায় বলে কাপড় বুনার উপযোগী উন্নত মানের সুতাও তৈরি হয় পাট তন্তু থেকে।
পরিবেশ সচেতনতার কারণে বিশ্বজুড়ে প্রাকৃতিক তন্তু ব্যবহারের প্রতি আগ্রহ বাড়ায় দিন দিন বাড়ছে পাট তন্তুর কদর। বাড়ছে পাট পণ্যের উৎপাদন ও রপ্তানিও।
বৈদেশিক বাণিজ্য: একসময় পাট ছিল বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস। সেই ধারা এখনো বর্তমান।
বাংলাদেশেরে মোট রপ্তানি আয়ের ৩-৪ শতাংশই আসে পাট থেকে।বিশ্বে উৎপাদিত মোট পাটের এক তৃতীয়াশ উৎপাদন করে বাংলাদেশে। উৎপাদিত পাটের নব্বই শতাংশ রপ্তানি করে মেটায় বিশ্ব চাহিদার এক চতুর্থাংশ।
দারিদ্রতা দূর: দেশের ৪০-৪৫ লাখ চাষী পাট চাষের সাথে প্রতক্ষ্য ভাবে যুক্ত। পাট ও পাট পণ্যের উৎপাদন, প্রকৃয়াজাতকরণ এবং বিপণনের সাথে জড়িয়ে রায়েছে প্রায় ৪ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা।
পরিবেশবান্ধব: ১ হেক্টর জমির পাট প্রতি ১০০ দিনে বায়ু থেকে প্রায় ১৫ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে ফিরিয়ে দেয় প্রায় ১১ টন অক্সিজেন।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি প্রতিরোধে পরিবেশবান্ধব এই পাট অনন্য এক বিকল্প।
অন্যান্য: পাট গাছের কোন কিছুই ফেলনা নয়। চারা থাকতে এই উদ্ভিদ বিভিন্ন জায়গায় খাওয়া হয়। এটি প্রচুর পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধও।
এছাড়াও আঁশ ছাড়ালেই পাট খড়ি মেলে। পাট গাছ থেকে আঁশ যতটুকু পাওয়া যায় তার দ্বিগুণ পাওয়া যায় পাট খড়ি। যা দিয়ে দেশের বিভিন্ন রকম জিনিসের চাহিদা মেটানো সম্ভব। যেমন-
পাটখড়ি দিয়ে তৈরি হয় ঘরের বেড়া ও ছাওনি।
জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
বাঁশের বিকল্প হিসেবে পাটখড়ি ব্যবহৃত হয় পার্টিক্যাল বোর্ড এবং এর মন্ড থেকেও কাগজ তৈরি করা হয়।
উৎপাদন, উন্নয়ন এবং বহুমুখী করণের সুবাদে পাটের সোনালী আঁশ আবারো মর্যাদার আসন গ্রহণ করতে চলেছে বিশ্বসভায়।
আর এই উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে আমাদেরও সচেষ্ট হতে হবে। তাই আসুন বিদেশী পণ্য বর্জন করে দেশীয় সংস্কৃতি ধরে রাখতে আমরা আমাদের দেশীয় পণ্য ব্যবহার করি।

Check Also

উপজেলা নির্বাচন: বেসরকারি ফলে জয়ী হলেন যারা

বিচ্ছিন্ন কয়েকটি ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। ভোট গণনা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

x